গাজীপুর অনলাইনঃ ছত্রাক জাতীয় সুস্বাদু খাবার মাশরুম। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশেও খাবার হিসেবে মাশরুম বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু মাশরুম চাষের জন্য খুবই উপযোগী হওয়ায় বাড়ছে মাশরুম চাষের ব্যাপকতা। মাশরুম চাষ প্রকল্পের আওতায় বর্তমানে সারা দেশে ১৬টি হর্টিকালচার সেন্টারে মাশরুম সাব-সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। ৩৫০ জন বেসরকারি মাশরুম চাষি বীজ উৎপাদন করছেন। তাছাড়া ১৫টি মাশরুমভিত্তিক খাদ্যশিল্প ও ১টি ওষুধ শিল্প গড়ে ওঠেছে। সব মিলিয়ে মাশরুম চাষে সরাসরি সম্পৃক্ত আছেন লক্ষাধিক মানুষ।
বাংলাদেশে মাশরুমের সম্ভাবনা
স্বল্প পুঁজি, কম সময় ও সহজে চাষ করা যায় বলে মাশরুম চাষ এরই মধ্যে জনপ্রিয় উঠেছে। মাশরুম চাষের পরিধি যেভাবে বিস্তার লাভ করছে তাতে অচিরেই মাশরুম অন্যতম অর্থনৈতিক পণ্যে পরিণত হবে। তাছাড়া এ শিল্পে হাজার হাজার বেকার নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি মাশরুম ১৫০-২০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। যদি কোনো কারণে কখনও মাশরুম বিক্রি করা না যায়, সে ক্ষেত্রে মাশরুম শুকিয়ে ড্রাই করে রাখা যায়। বাজারে প্রতি কেজি ড্রাই মাশরুমের দাম ১ হাজার থেকে ১২শ’ টাকা। ড্রাই মাশরুম পানিতে ভেজালে আবার কাঁচা মাশরুমের মতো হয়ে যায়। বাণিজ্যিকভাবে মাশরুম চাষ বাড়ালে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়েও বিদেশে রফতানি করা সম্ভব। মাশরুমের সম্ভাবনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছ জাতীয় মাশরুম সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন কেন্দ্র। এ প্রতিষ্ঠান দেশি-বিদেশি জাতের মাশরুমের গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরি, পুষ্টিহীনতা দূরীকরণ ও বেকার সমস্যার সমাধানে কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি উদ্যোক্তা সৃষ্টি করাসহ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার সৃষ্টিতে সহায়তার উদ্দেশ্য নিয়ে এই প্রতিষ্ঠান কাজ করছে।
মাশরুমের পুষ্টিগুণ
পুষ্টির গুণ বিচারে মাশরুমে মাছ-মাংসের চেয়ে কিছু বেশি এবং প্রচলিত শাক-সবজির চেয়ে দ্বিগুণ খনিজ পদার্থ, প্রচুর ভিটামিন, উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আমিষ এবং হজমে সাহায্যকারী এনজাইম রয়েছে। প্রতি ১০০ গ্রাম মাশরুমে থাকে ৩.১ গ্রাম আমিষ, ০.৮ গ্রাম স্নেহ, ১.৪ গ্রাম খনিজ পদার্থ, ০.৪ গ্রাম আঁশ, ৪.৩ গ্রাম শর্করা, ৬ মিলিগ্রাম কেলসিয়াম, ১১০ মিলিগ্রাম ফসফরাস, ১.৫ মিলিগ্রাম লৌহ, ০.১৪ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি১, ০.১৬ মিলিগ্রাম বি২, ২.৪ মিলিগ্রাম নায়াসিন, ১২ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি। এ ছাড়া খাদ্যশক্তি থাকে ৪৩ কেলোরি। এ ছাড়াও এতে যে ফলিক এসিড থাকে তা অ্যামিনিয়া প্রতিরোধে সহায়তা করে। খাবারের তালিকায় নিয়মিত মাশরুম থাকলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়াও ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ভাইরাসজনিত রোগসহ বিভিন্ন জটিল রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করে।
মাশরুম চাষ পদ্ধতি
মাশরুম চাষের জন্য আবাদি জমির প্রয়োজন হয় না। বেকার তরুণ-তরুণী এবং মহিলারা ঘরে বসেই এর চাষ করতে পারেন। গ্রীষ্মকালে যে কোনো চালাঘরের নিচে এবং বারান্দায় চাষ করা যায়। বর্ষাকালে পানি প্রবেশ করে না। অথচ বাতাস চলাচলের সুবিধা আছে এমন ঘরে মাশরুম চাষ করতে হয়। শীতকালে ভেজা স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার ঘরে এর চাষ হয়ে থাকে। চাষের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণও সহজলভ্য। সাধারণত মাশরুম চাষ করতে বীজ, ধানের খড়, পাতলা পলিথিন ব্যাগ, ঝুলন-শিকা বা বাঁশ, ছিদ্রযুক্ত কালো পলিথিন সিট, ঘরের উষ্ণতা ও আদ্রর্তা পরিমাপের জন্য হাইগ্রোমিটার, ঘরের উষ্ণতা ও আদ্রর্তা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য হ্যান্ড সপ্রেয়ার, জীবাণুনাশক, বোর্ড বা ছোট ছুরি, বালতি ইত্যাদি উপকরণ লাগে। বাংলাদেশে গ্রীষ্ম এবং বর্ষাকালে ‘স্ট্র মাশরুম’ এবং শীতকালে ‘ওয়েস্টার’ জাতের মাশরুম চাষ উপযোগী। খড়ের বেডে মাশরুম চাষ সাধারণত দু’ধাপে সম্পন্ন হয়ে থাকে। প্রথম ১৭ থেকে ২০ দিন ওমঘরে তারপর ফসল উৎপাদনের জন্য চাষঘরে ২১ দিন থেকে ৪৫ দিন রাখতে হয়। ওমঘর এবং চাষঘর যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণই হলো মাশরুম চাষের মূল কৌশল।
মাশরুমের প্রকারভেদ
সারা পৃথিবীতে প্রায় ৩ লাখ প্রজাতির মাশরুমের মধ্যে মাত্র ১০ প্রজাতির মাশরুম এখন পর্যন্ত খাবার হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। তবে ১০ হাজার মাশরুমের ওপর গবেষণা চলছে। বাংলাদেশে ঋষি মাশরুম, গুটি বা বাটন মাশরুম, মিল্ক হোয়াইট মাশরুম, ওয়েস্টার মাশরুম, স্ট্র মাশরুমের চাষ করা হচ্ছে। অধিক পরিমাণ লাভজনক হওয়ায় অনেকে বাংলাদেশের অনেক এলাকার বেকার যুবক মাশরুম চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। বর্তমানে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজবাড়ী, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহীসহ সারাদেশেই মাশরুম চাষ করা হচ্ছে। ঢাকার গোড়ান, কোর্ট-কাচারি এলাকা, রামপুরা, বনশ্রী, সাভার ও টঙ্গীতে বাণিজ্যিকভাবে মাশরুম চাষ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে মাশরুমের ইতিহাস
যতদূর জানা যায়, ১৯৭৬ সালে কৃষি উপদেষ্টা ও কৃষি পরিচালক সহিদুল ইসলাম সরকারিভাবে নেদারল্যান্ডসে মাশরুম সংক্রান্ত ট্রেনিং ও প্রশিক্ষণ নেন, প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে তিনি কৃষি পরিচালকের মাশরুম সম্পর্কে অবহিত করেন এবং প্রাপ্ত প্রযুক্তিগুলো হস্তান্তর করেন। তারপর থাইল্যান্ড থেকে বীজ সংগ্রহ করে মাশরুম চাষ শুরু করা হয়। তার পরের ইতিহাস সবার জানা। আসাদগেটের হর্টিকালচার সেন্টারে প্রাথমিকভাবে মাশরুম চাষ শুরু হলেও ১৯৮২-৮৩ সালে ১৪ একর ২৭ শতাংশ জায়গায় কাকি জাকি নামক এক জাপানি বাংলাদেশে মাশরুমের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে কাজ করেন। ১৯৮০ সাল থেকে জাতীয় মাশরুম উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা পেলেও প্রকৃতপক্ষে এর প্রচার ও প্রসার হয় ২০০৪ সালে। তারপর থেকে বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মাশরুম উৎপাদন ও সম্প্রসারণ ব্যাপকতা লাভ করে।
ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশে মাশরুমের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে এ চাহিদা মেটাতে বিদেশ থেকেও মাশরুম আমদানি করা হচ্ছে। দেশে বাণিজ্যিকভাবে মাশরুম চাষ বাড়ালে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়েও বিদেশে রফতানি করা সম্ভব।