গাজীপুর অনলাইন: আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যাকাণ্ড নিঃসন্দেহে একটি জঘন্যতম ঘটনা। ইতিহাসে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড অতিতে খুব কমই ঘটেছে।এ হত্যার মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন কোন পর্যায়ে পৌছেছে। বুধবার এ হত্যাকাণ্ডের করা মামলার আপিলের রায়ে হাইকোর্ট এই পর্যবেক্ষণ দেন।
আদালত বলেন, যে হত্যাকাণ্ডটিকে কেন্দ্র করে এই ডেথ রেফারেন্স আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে নিঃসন্দেহে এটি জঘন্যতম ঘটনা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড অতীতে খুব কমই সংঘটিত হয়েছে। রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন কোন পর্যায়ে পৌছেছে তা টংগীর নোয়াগাঁও এম এ মজিদ স্কুলে সংঘটিত ঘটনা প্রবাহ থেকে সম্মক উপলব্ধি করা যায়।’
বুধবার বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। রায়টি লিখেছেন বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ। দুপুর একটায় রায় পড়া শুরু হয়। শুরুতে কিছু অবজারভেশন দেন বেঞ্চের সিনিয়র বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। এরপর রায়ের অপারেটিভ অংশ পড়ে শুনান অপর বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ।
আসামীরা যে সেই দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতিরই আদালত পর্যবেক্ষণে সেকথাও উল্লেখ করেছেন। আদালত বলেন, নুরুল ইসলাম সরকারের সঙ্গে তখনকার সময়ের সদ্য ক্ষমতাচ্যুত রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগের অঙ্গ সংগঠন এবং আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা মাহফুজুর রহামন মহলের সঙ্গে যতোটুকু ঘটনা না ছিল রাজনৈতিক বৈরিতা তার চেয়েও বেশি ছিল অর্থনৈতিক সংঘাত।
ঘটনার বিস্তারিত বিবরণে দেখা যায় উভয়ের মধ্যে স্থানীয়ভাবে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের একটি প্রতিযোগিতা চলছিল। মহলের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হলেও যেহেতু নুরুল ইসলাম সরকারের বিচ্ছিন্ন মাদক ব্যবসায় বাধা সৃষ্টি করেছিলেন, সেহেতু নুরুল ইসলাম সরকার ও সঙ্গীগণ মহলকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন।
আহসানউল্লাহ মাস্টারকে পরিকল্পিতভাবেই হত্যা করা হয়েছে উল্লেখ করে আদালত বলেন, এটা পরিস্কার অভিযুক্তরা সভাটি করছিলেন তখনই তারা জানতেন নিকট ভবিষ্যতে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে এবং সেখানে মাহফুজুর রহমান মহলসহ অনেকেই আসবেন এবং মহলকে সেখানেই হত্যা করা হবে বলে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এটি বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এরকম সম্মেলনে স্থানীয় সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টারসহ আরও নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থাকবেন এটি ষড়যন্ত্রকারীরা ভালোভাবেই জানতেন।
আদালত আরও বলেন, ওই জনসভায় যেখানে আহসান উল্লাহ মাস্টার এমপিসহ টঙ্গী পৌরসভার মেয়র ও অন্যান্য আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দসহ শত শত দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ উপস্থিত থাকবেন তা জেনেও সাজাপ্রাপ্ত অভিযুক্তরা মাহফুজুর রহমান মহলকে মারার জন্য ঐ স্থানটিকেই কেন বেছে নেয়। কারণ সাজাপ্রাপ্ত অভিযুক্তগণের মধ্যে কোনো দ্বিধা কাজ করেনি যে এই সভায় বিক্ষিপ্তভাবে গোলাগুলি করলে প্রচুর লোক মারা যেতে পারে। এমনকি তারা প্রকাশ্য দিবালোকে সংগঠিত এই ঘটনার সময় কোনোরকম মুখাবরণ (মাস্ক) পর্যন্ত ব্যবহার করেননি।
এর কারণ হিসেবে আদালত উল্লেখ করেন তারা এতোটাই বেপরোয়া ছিলেন এবং ভেবেছিলেন যে তাদের চেহারা অনাবৃত থাকার কারণে কেউ যদি তাদেরকে চিনেও ফেলে তথাপিও তাদের কিছু হবে না। তাদের এই ধরনের ভাবনার কারণ হল তাদের পেছনে এমন একটি শক্তি রয়েছে যে বা যারা তাদেরকে সকল প্রকার ভবিষ্যত সম্ভাব্য ঝামলা থেকে রক্ষা করার শক্তি রাখেন। স্থানীয় বেপরোয়া উশৃঙ্খল রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা এ ধরনের চিন্তা করতে পারে কারণ আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ ধরনের উশৃঙ্খল কর্মীদেরকে পরিহার করার প্রবণতা দেখা যায় না এবং অনেকাংশে তারা এদের উপর নির্ভরশীল, যা কিনা দেশে সুষ্ঠু রাজনীতি বিকাশের ক্ষেত্রে এক বিরাট অন্তরায়। সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাল না ঘটলে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। মুখ থুবড়ে পড়বে গণতন্ত্র।
প্রকাশ্য জনসভায় এ ধরনের হত্যাকাণ্ডকে মাস কিলিং উল্লেখ করে আদালত বলেন, যে স্থানে ও যেভাবে এই হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছে এইরুপ হত্যাকাণ্ডকে এক কথায় বলা চলে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড বা মাসকিলিং। যেখানে কোনো অপরাধমূলক কার্যক্রম দ্বারা হত্যার উদ্দেশ্যে এক নিরস্ত্র বা বৃহৎ সমাবেশে আক্রমন করা হয় এবং যেখানে অসংখ্য লোক নিহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যদি সেখানে একজন লোকও নিহত হন এই ধরনের হত্যাকাণ্ডকে বলা যায় ব্যাপক হত্যাকাণ্ড বা মাস কিলিং।
আহসান উল্লাহ মাস্টারকে আদর্শবান রাজনৈতিক উল্লেখ করে আদালত বলেন, আহসান উল্লাহ মাসআর জীবনের শুরুতে ছিলেন একজন শিক্ষক পরবর্তীতে প্রধান শিক্ষক এবং নির্বাচিত প্রতিনিধি। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সবশেষ জাতীয় সংসদের একজন সদস্য হিসেবে একাধিকবার নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন দলমত নির্বিশেষে সকলের শ্রদ্ধাভাজন।
তার হত্যাকাণ্ডে পরিবার ও জনগণ তার সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে বলে আদালত উল্লেখ করেন। আদালত বলেন, আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যার মধ্য দিয়ে তার স্ত্রীকে স্বামীর ভালোবাসা ও পুত্র সন্তানদেরকে পিতার স্নেহ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করা হল। নিহত ওমর ফারুক রতনকে হত্যার মধ্য দিয়ে হত্যা করার হল একটি নিস্পাপ তরুণকে। আহসান উল্লাহ মাস্টারের মতো একজন আদর্শবান সংসদ সদস্য হিসেবে বেচে থাকলে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে জনগণের কল্যাণে তিনি আরও অনেক ভাল কাজ করতে পারেতন যা থেকে জাতি উপকৃত হতো।’
দীর্ঘদিন পর হওয়া এই রায়ের ব্যাপারে আদালত বলেন, আজ আহসান উল্লাহ মাস্টারের স্ত্রী, পুত্র, কন্যাগণ এই হত্যাকাণ্ডের সঠিক বিচার যেমন চান। অন্যদিকে ২০০৫ সালের এপ্রিল দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ কর্তৃক রায় প্রদান করার দিন থেকে বা তার পর থেকে যারা কারাগারে আছেন তারাও ন্যায়বিচারপ্রার্থী। প্রত্যেক সাজাপ্রাপ্ত অভিযুক্তের ঘটনার সহিত তার সম্পৃক্ততা সাক্ষ্য পর্যালোচান করে অপরাধের গভীরতা ও অন্যান্য প্রাসংগিক বিষয়ে বিবেচনা নিয়ে আমরা এই রায় প্রদান করলাম।
আসামীদের সাজা প্রদানের ভিত্তি সম্পর্কে আদালত বলেন, এই মামলায় অভিযুক্তদের সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে প্রেক্ষাপট বিবেচনা এবং প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবে অভিযুক্ত ব্রক্তিগণের সামাজিক অবস্থান, ঘটনার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা এবং সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও আনুষাংগিক সংশ্লিষ্টবিষয়াদীয় বিবেচনায় নিয়ে সিস্টার মাননীয় বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ যে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছেন এর সাথেও আমি সম্পূর্ণ একমত পোষণ করছি।
প্রসঙ্গত, গাজীপুরের আওয়ামীলীগ নেতা আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলায় নিম্ন আদালতে ২২ জনের মধ্যে ছয় জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। এছাড়া বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বাকিদের মধ্যে সাতজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও সাতজনকে খালাস দিয়েছেন আদালত। বাকি দুজন বিচার চলাকালে মারা যাওয়ায় তাদের আপিল নিস্পত্তি করে দেওয়া হয়েছে।
তাই আসামীদের মধ্যে ৬ জনের মৃত্যুদণ্ড, ৮ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ১১ জন খালাস পেয়েছেন। এছাড়া দুজন বিচার চলাকালে মারা যাওয়ায় তাদের আপিল নিস্পত্তি করে দেওয়া হয়েছে। যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত অপর একজন পলাতক থাকায় তার ব্যাপারে আদালত কোনো রায় দেননি।