
শনিবার মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে দুপুর ১২ টায় ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালের শ্রীলঙ্কার মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। এ নিয়ে চতুর্থবারের মতো কোন টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠেছে বাংলাদেশ। আগের প্রত্যেকবারই শিরোপার খুব কাছাকাছি গিয়ে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে টাইগারদের। পুড়েছে ব্যর্থতার অনলে। এবারের ত্রিদেশীয় সিরিজের শুরুটা ছিল দুর্দান্ত। ফাইনালের আগের শেষটায় বিরাট ধাক্কা খেয়েছে টাইগাররা। লজ্জা। তবে সেটা নিয়ে না ভেবে শুরুর মতো শেষটাও দুর্দান্তভাবে করতে চায় স্বাগতিকরা। আর শুরুর মতো জয়ের উদযাপন দিয়ে যদি টুর্নামেন্টটা শেষ করতে পারে মাশরাফির দল, তবেই এতকালের অধরা শিরোপায় চুমু খাওয়ার আরাধনা পাবে বাস্তবতা।
ঘটনা ১ (১৫ জানুয়ারি ২০০৯)
টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী ম্যাচেই হোঁচট। অপেক্ষাকৃত দুর্বল দল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৩৮ রানের পরাজয়। তাই ঘরের মাঠে দর্শক হতে না চাইলে শ্রীলঙ্কাকে হারাতে তো হবেই, সঙ্গে রান রেটও বাড়াতে হবে। সেই দুরূহ কাজটিই করে দেখিয়েছিল টাইগাররা। তখন খুব তরুণ সাকিব আল হাসানের আতিমানবীয় ব্যাটিংয়ে ফাইনালে ঠিকই জায়গা করে নিয়েছিল বাংলাদেশ। তবে ফাইনালেই দুঃস্বপ্ন। গ্রুপপর্বে যে শ্রীলঙ্কার বোলারদের গলির বোলারের মতো পিটিয়ে সহজ জয় ঘরে তুলেছিল টাইগাররা সেই তাদের বিপক্ষে আগে ব্যাটিং করে ১৫২ রানের পুঁজি। তবে এরপরও লড়াইটা দুর্দান্ত। ৬ রানে নেই লঙ্কানদের ৫ উইকেট। কিন্তু অভিজ্ঞ কুমার সাঙ্গাকারা আর শেষ দিকে আচমকা ব্যাটসম্যান হয়ে উঠে ইতিহাসসেরা বোলার মুত্তিয়া মুরালিধরনের আগ্রাসী ব্যাটিং খুন করল বাংলাদেশের স্বপ্নকে। শিরোপার খুব কাছে গিয়েও খালি হাতেই ফেরার বুকভাঙা কষ্ট সেবার মোহাম্মদ আশরাফুলের দলের।

ঘটনা ২ (২২ মার্চ ২০১২)
ঘরের মাঠে এশিয়া কাপ। কিন্তু উদ্বোধনী ম্যাচেই পাকিস্তানের কাছে হারতে হয় স্বাগতিকদের। ফাইনাল খেলতে হলে পরের দুই ম্যাচেই জিততে হবে। শক্তিশালী ভারত আর এশিয়া কাপে বরাবরই ছন্দে থাকা শ্রীলঙ্কা প্রতিপক্ষ। সঙ্গে রানরেট বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তাও আছে। আর তাতে দারুণভাবে সফল মুশফিকুর রহীমের দল। দুই দলকেই ৫ উইকেটের ব্যবধানে হারিয়ে ফাইনালের টিকিট কাটে দলটি। তবে ফাইনালে সেই পুরনো চিত্র। তীরে এসে তরী ডোবে। পাকিস্তানের কাছে প্রায় জেতা ম্যাচে মাত্র ২ রানে হেরে যাওয়ার বিয়োগান্ত নাটক। অথচ পুরো ম্যাচে বাংলাদেশের ছিলো একচ্ছত্র আধিপত্য। তাই এমন ম্যাচে হারার পর বুকভাঙ্গা কান্না লুকিয়ে রাখতে পারেননি সাকিব-মুশফিক-নাসিররা। মাঠের সবুজ ঘাস আর গোটা ক্রিকেট বিশ্বকে স্পর্শ করেছিল সেই ক্রিকেট আবেগ, ভালোবাসা। টাইগারদের স্মৃতির পাতায় আজও যা জ্বলজ্বলে।
ঘটনা ৩ (৬ মার্চ ২০১৬)
সংস্করণ বদলে ওয়ানডে থেকে টি-টুয়েন্টিতে এশিয়া কাপ। আর এবারও হার দিয়েই শুরু। উদ্বোধনী ম্যাচে শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষে ৪৫ রানের হার। ফাইনালে যেতে চাইলে পরের তিন ম্যাচেই জেতা চাই টাইগারদের। কাজটাও সহজ নয়। কোয়ালিফায়ার খেলে মূলপর্বে ওঠা আরব আমিরাত ছাড়া পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা দুই দলই এই সংস্করণে সফল। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নও। কিন্তু টাইগারদের দুর্দান্ত দাপটে টানা তিন ম্যাচ জিতেই ফাইনালে ওঠার গৌরব টাইগারদের। এরপর শেষ গর্জনের অপেক্ষা। কিন্তু ফাইনালে গিয়ে আবারও সেই পুরোনো স্বপ্নভঙ্গের গল্প। বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে নির্ধারিত ১৫ ওভারে ১২০ রানের সংগ্রহ বাংলাদেশের। তবে শিখর ধাওয়ানের দায়িত্বশীল ব্যাটে ও অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির ঝড়ো ব্যাটিংয়ে ভারতের বিপক্ষে শেষ রক্ষা হয়নি মাশরাফি বিন মুর্তজার দলের।

আগের তিনটি ঘটনার সাক্ষীই মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম। সাথে মাঠের দর্শক, গোটা দেশ, দেশের বাইরের সকল ক্রিকেটপ্রেমী বাংলাদেশি। কাকতালীয়ভাবে টাইগারদের ক্রিকেট ইতিহাসে এ তিনবারই কোনো টুর্নামেন্টের ফাইনালে খেলার অভিজ্ঞতা হয়েছে। আর প্রতিবারই বাজে শুরুর সঙ্গে সঙ্গে শেষটাও বাজে হয়েছে বাংলাদেশের। শনিবারের ফাইনাল ম্যাচে নামার আগে ঘুরে ফিরে আসে আগের সেই দুঃস্মৃতি। তবে এসব নিয়ে ভাবছেনই না বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক মাশরাফি। এমনকি সেইসব স্মৃতি ভুলেই গেছেন অধিনায়ক। হাসতে হাসতেই জানালেন, ‘এইটা আসলে আমার মাথায় ছিল না। মনে না করাইলেই পারতেন।’ শুক্রবার বললেন নেতা।
আগের তিনটি ফাইনালের দলেই ছিলেন মাশরাফি। কখনো কেবল সদস্য, কখনো ক্যাপ্টেন। বর্তমান দলের তিন স্তম্ভ সাকিব, তামিম ও মুশফিকও ছিলেন। তবে অতীতের স্মৃতিকে অতীত মেনেই সামনে এগিয়ে যেতে চান মাশরাফি, ‘কালকে সম্পূর্ণ নতুন একটা ম্যাচ। তো আগের ম্যাচগুলো নিয়ে ভাবার দরকার মনে করছি না। তবে হারজিত তো থাকবেই, একদল জিতবে আর একদল হারবে। এটা নিয়ে না ভেবে আমার মনে হয় ইতিবাচক ক্রিকেট খেলা আর প্রথম তিনটা ম্যাচ যেভাবে খেলেছি, গতকালকের ম্যাচেও যে মাইন্ড সেটআপ নিয়ে খেলেছি সেই মাইন্ড সেট আপটুকু থাকুক। যেটা প্রত্যাশা ছিল, সেটা হয়তো মাঠে দিতে পারিনি। ওইটা আবার না হলেই হয়।’

তবে এবার আর ফাইনালে হেরে কাঁদার ও কাঁদানোর পথ যে কোনো মূল্যে এড়াতে চায় বাংলাদেশ। যদিও নিজেদের শেষ ম্যাচে শ্রীলঙ্কার কাছে বিধ্বস্তই হয়েছে দলটি। তারপরও তরুণ ক্রিকেটারদের জন্য জয় চাই-ই চাই মাশরাফিদের। চাই শিরোপা। জয়ের স্বাদটা তাদের দিতে চাইছেন অধিনায়ক। কারণ রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘ যে বারবারই রক্তই চাইবে। আর একবার না পারিলে দেখ শতবারের প্রবাদে না গিয়ে চতুর্থবারেই আরাধ্য শিরোপায় চুমু খেয়ে স্বর্গ স্পর্শ করা চাই। একজনও বাংলাদেশির হৃদয় না ভেঙে। মাশরাফির তাই প্রবল প্রত্যয়ে উচ্চারণ করেন, ‘যদি জিততে পারি তবে এটার প্রভাব ভালো হবে। এখন যারা ড্রেসিংরুমে আছে, যারা জুনিয়র খেলোয়াড়, তারা হয়তোবা এরকম একটা জয়ের স্বাদ কি, এ রকম ম্যাচ জিতলে কেমন লাগে, এটা বুঝবে। তখন হয়তোবা তাদের মধ্যে ওই চাওয়াটা, বা জয়ের ক্ষুধাটা তৈরি হতে পারে। এইসব ক্ষেত্রে কখনো কখনো এমন টুর্নামেন্ট জিতলে জুনিয়র খেলোয়াড়রা অনেক বুস্টআপ হয়।’ ভবিষ্যতে সেটাই যে আরো অনেক শিরোপা জেতাবে, মাশরাফির কথায় সেটা উহ্য থাকলেও মন থেকে তো তাই বলে গেলেন।
তবে শুধুই যে জুনিয়র খেলোয়াড়দের কথাই ভাবছেন মাশরাফি তাও নয়, অভিজ্ঞদের জন্যও এটাকে অসাধারণ সুযোগ মানছেন অধিনায়ক, ‘সিনিয়রদের কথা যদি বলি, আমাদের জন্যও এটা একটা দারুণ সুযোগ। আমার মনে হয় যে, এরকম টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা যে কোন টিমের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার।’
আর প্রথমবারের মতো কোন ফাইনালে জিততে দারুণ মরিয়া টাইগাররা। টুর্নামেন্টে অসাধারণ দাপটের শুরুর গল্প সবার জানা। ভুলে ভরা শেষ ম্যাচের শিক্ষা নিয়েই নতুন ইতিহাস লেখা চাই এবার মাশরাফি-সাকিব, তামিম-মুশফিক, মোস্তাফিজ-রুবেলদের। ‘আমরা প্রথম দুইটা ম্যাচ জিতেই যেহেতু ফাইনালে গিয়েছি, ফাইনাল আমাদের সামনে এসে গেছে। আমাদের এখন ফাইনাল আরেকটা ম্যাচ হিসেবেই খেলতে হবে। শুধু খেয়াল রাখতে হবে গতকালের ম্যাচে যেসব ভুল করেছিলাম আগামীকালের ম্যাচে যেন পুনরাবৃত্তি না হয়। ভুল তো হবেই অবশ্যই, ভুলের সংখ্যা যেন অনেক কমে আসে। তাহলে হয়তো এই ম্যাচে যে চাপ থাকবে তা নিজে থেকেই কমে যাবে। শুরুটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাটিং বা বোলিং যাই করি না কেন, শুরুতে খেলা কিছুটা ধরতে পারলে কিছুটা হলেও চাপ ধীরে ধীরে কমে আসে।’
ফাইনালে জয়ের ইতিহাস না থাকলেও একটি ত্রিদেশীয় সিরিজ জয়ের রেকর্ড আছে টাইগারদের। ২০০৭ বিশ্বকাপের আগে অ্যান্টিগায় সহযোগী দেশ বারমুডা ও কানাডাকে নিয়ে একটি প্রস্তুতিমূলক টুর্নামেন্ট আয়োজন করে আইসিসি। তবে টুর্নামেন্টে কোন ফাইনাল ছিলো না। গ্রুপপর্বের দু’টি ম্যাচ জিতে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশই। তবে এবার ফাইনালে জিতে শিরোপায় চুমু খাওয়াটাই লক্ষ্য টাইগারদের।
শেষ ভালো যার সব ভালো তার। শুরুর মতো শেষটাও দারুণ রঙে রাঙিয়ে গোটা জাতিকে উৎসবমুখর করে উদযাপনের আলোয় আলোকিত করতে পারবে তো টাইগাররা? বিশ্বাস মাশরাফির দুর্ধর্ষ দলটার আছে। কিন্তু ক্রিকেটে যে ভাগ্যটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ!