ওসমান পরিবারের উত্থান, পতন

শাখাওয়াত লিটন: নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবারের চমকপ্রদ ইতিহাস রয়েছে। প্রগতির পক্ষে সব লড়াইয়ে সামনের সারিতে থেকে নারায়ণগঞ্জে যে পরিবারটির উত্থান হয়েছিল দুই পুরুষ বাদে সেই পরিবারেরই উত্তরসূরিদের কর্মকাণ্ডের কারণে অতীত মান-মর্যাদা আজ ডুবতে বসেছে।

সর্বশেষ গত মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জের রাজপথে মাঠে দেখা যায় আওয়ামী লীগের সাংসদ শামীম ওসমান ও তার অনুসারীদের। হকার বাসানো ও উচ্ছেদ নিয়ে সেদিন মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভির ওপর হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। এই ঘটনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যেমন বিরক্তির কারণ হয়েছে তেমনি নির্বাচনের বছরে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে আওয়ামী লীগকে।

তবে নারায়ণগঞ্জে সেদিন যা হয়েছে সেটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। শামীম ওসমান ও তার অনুসারীরা বছরের পর বছর ধরে নানা বেআইনি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন।

শামীম ওসমানের ভাই জাতীয় পার্টির সাংসদ সেলিম ওসমান সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসেন ২০১৬ সালে। পরিবারের মর্যাদা বিসর্জনে তিনিও কম যাননি। ২০১৬ সালের ১৩ মে সেলিম ওসমানের সামনে একজন প্রবীণ শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। ওই ঘটনার পরও নানাভাবে হেনস্থার শিকার হতে হয় তাকে। জনসমক্ষে স্কুল শিক্ষকের অপমান সেসময় দেশব্যাপী প্রতিবাদের জন্ম দিয়েছিল। ক্ষুব্ধ করেছে মানুষকে।

কিন্তু ওই ঘটনাতেই মৌলবাদী সংগঠন হেফাজতে ইসলামকে মাঠে নামলে পরিস্থিতি নাটকীয় মোড় নেয়। সেলিম ওসমানের সাজার দাবিতে মানুষ যখন সোচ্চার ঠিক তখনই আরেকটি মৌলবাদী সংগঠন খতমে নবুওয়্যাতকে নিয়ে সেলিম ওসমানের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় হেফাজত। ইসলাম অবমাননার ধোঁয়া তুলে তারা শ্যামল কান্তি ভক্তের সর্বোচ্চ সাজা দাবি করতে থাকেন। সেলিম ওসমান তখন জাতীয় পার্টির নেতা থেকে হয়ে ওঠেন মৌলবাদীদের নেতা।

ঘটনা তদন্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠন করা কমিটি শ্যামল কান্তিকে সম্পূর্ণ নির্দোষ বলে প্রতিবেদন দেন ও তাকে স্বপদে বহাল রাখার সুপারিশ করেন। কিন্তু সেলিম ওসমানের সমর্থনে নারায়ণগঞ্জে মৌলবাদীদের আস্ফালন চলতেই থাকে। তারা শিক্ষামন্ত্রীরও পদত্যাগের দাবি তোলেন।

ওসমান পরিবারের গোড়াপত্তন হয়েছিল যার মাধ্যমে সেই ওসমান আলী গত শতাব্দীর ’৪০ এর দশকে নারায়ণগঞ্জে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান আন্দোলন শুরু হলে তিনি নারায়ণগঞ্জে বামপন্থী ও অন্যান্য স্থানীয় নেতাদের সহযোগিতায় সেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধরে রাখার চেষ্টা করেন।

ওসমান পরিবারের উত্থান

নারায়ণগঞ্জে ওসমান পরিবারের গোড়াপত্তন করেন সেলিম ও শামীমের দাদা এম ওসমান আলী। ১৯২০ এর দশকে তিনি কুমিল্লা থেকে নারায়ণগঞ্জে আসেন। তার সম্পর্কে যা জানা যায় তা হলো, রাজনীতি, ব্যবসা, সমাজসেবা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে ওসমান আলী তখন থেকেই নারায়ণগঞ্জে সুপরিচিত হয়ে উঠেন।

ওসমান আলী ১৯৩৮ সালে নিজ গ্রামে একটি প্রাথমিক ও একটি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের তানজিম মুসাফিরখানা, রহমতুল্লাহ অডিটোরিয়াম ও গণপাঠাগার নির্মাণে তার অবদান ছিল। এসব জনহিতকর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রিটিশ সরকার তাকে ১৯৪০ সালে ‘খান সাহেব’ উপাধিতে ভূষিত করে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের দমননীতির প্রতিবাদে তিনি ১৯৪৪ সালে উপাধি বর্জন করেন। ব্রিটিশদের উপাধি বর্জনের সাহসী সিদ্ধান্তের জন্যও সেসময় তিনি সমানভাবে প্রশংসিত হন।

লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান আন্দোলন শুরু হলে ওসমান আলী নারায়ণগঞ্জে আন্দোলনকে সংগঠিত করেন এবং বামপন্থী ও অন্যান্য স্থানীয় নেতাদের সহযোগিতায় সেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার চেষ্টা করেন। ১৯৪৬ সালে নারায়ণগঞ্জে ‘ঝুলন যাত্রা’কে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হলে হিন্দু ও মুসলমানদের সমঝোতায় আনতে তিনি ভূমিকা রাখেন।

ওসমান আলী ১৯৪৬ সালে সাধারণ নির্বাচনে (নারায়ণগঞ্জ দক্ষিণ নির্বাচনী এলাকা) ঢাকার নবাব খাজা হাবিবুল্লাহকে পরাজিত করে বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি নারায়ণগঞ্জ শহর মুসলিম লিগের সভাপতি এবং ঢাকা জেলা মুসলিম লিগের সহ-সভাপতি ছিলেন। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি নারায়ণগঞ্জ শহর মুসলিম লিগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ঢাকা জেলা মুসলিম লিগে ঢাকার নবাবদের সঙ্গে প্রগতিশীল গ্রুপের মতবিরোধ দেখা দেয়। এ বিরোধে ওসমান আলী প্রগতিশীল গ্রুপকে সমর্থন করেন এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে নারায়ণগঞ্জে গণসংবর্ধনা দেন।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য ছিলেন এম ওসমান আলী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সেসময়ের রাজনীতিবিদরা তাকে অত্যন্ত সমীহ করতেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তার বিশেষ ভূমিকা ছিল। এ জন্য তিনি কারারুদ্ধ হন। ১৯৬২ সালের শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন, ছয়দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ওসমান আলী সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।

বাংলাপিডিয়ায় এম ওসমান আলী সম্পর্কে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে তাতে বলা হয়, তিনি সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগী ছিলেন। তার সম্পাদনায় ত্রিশের দশকে নারায়ণগঞ্জ থেকে সবুজ বাঙলা নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এ পত্রিকায় লিখতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মোহিতলাল মজুমদার, জসীমউদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, বন্দে আলী মিয়া, কাজী আবদুল ওদুদ, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা প্রমুখ। ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ তিনি প্রয়াত হন।

বাবার পথ ধরেই রাজনীতিতে এসে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন ওসমান আলীর বড় ছেলে একেএম সামসুজ্জোহা। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে নির্বচনে তিনি সাংসদ হন। বঙ্গবন্ধুর সাথে রাজনীতির ময়দানে থাকা সামসুজ্জোহা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। সরকারি বার্তা সংস্থা বাসসের খবরে জানানো হয়, মৃত্যুর ২৯তম বার্ষিকীতে এসে ২০১৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হয়।

ওসমান পরিবারের পতন

সামসুজ্জোহা বেঁচে থাকতেই তার বড় ছেলে নাসিম ওসমান স্বৈরাচার এরশাদের শাসনামলে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৮৬ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে তিনি সাংসদ হন। পরবর্তীতে ১৯৮৮, ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির টিকিটে তিনি এমপি হন।

২০১৪ সালের এপ্রিলে নাসিম ওসমানের আকস্মিক মৃত্যুতে সেলিম ওসমানের সাংসদ হওয়ার সুযোগ আসে। সে বছর উপনির্বাচনে সাংসদ হন এই ব্যবসায়ী। নারায়ণগঞ্জের ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি সব কিছুতেই তার একচ্ছত্র আধিপত্যের অভিযোগ রয়েছে। তবে সাংসদ হওয়ার আগেই বড় ভাই নাসিম ওসমান ও ছোট ভাই শামীম ওসমানের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে নারায়ণগঞ্জের ব্যবসা বাণিজ্যকে নিজের কব্জায় নেন তিনি।

তবে ওসমান পরিবারের সুখ্যাতির পতন মূলত শুরু হয় ১৯৯৬ সালে শামীম ওসমানের এমপি হওয়ার পর থেকে। সাংসদ নির্বাচিত হয়েই নারায়ণগঞ্জের সবচেয়ে ভয়ংকর রাজনীতিবিদের তকমা লাগে তার গায়ে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে এক কথায় বলতে গেলে প্রায় পুরো নারায়ণগঞ্জ ছিল তার করায়ত্তে। শামীম ওসমান ও তার ক্যাডারদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে নারায়ণগঞ্জবাসী। স্থানীয় সন্ত্রাসীদের এই গডফাদারের বিরুদ্ধে কথা বলার মতো সাহসও দেখাতে পারেনি কেউ। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবির পর শামীম ওসমান প্রথমে ভারতে পালিয়ে যান। সেখান থেকে তিনি যান কানাডায়।

২০০৬ সালে ফিরে এসে নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক অঙ্গনে আবির্ভূত হলেও ২০০৭ সালের ওয়ান ইলেভেনের পট পরিবর্তনে আগের দিন তিনি দেশত্যাগ করেন। ফিরে আসেন ২০০৯ সালের এপ্রিলে। ততদিনে তার দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জের মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তার পক্ষে কাজ করলেও সেলিনা হায়াৎ আইভীর কাছে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত হতে হয়। কিন্তু শামীম ওসমানের বিরোধিতার কারণে মেয়র পদে থেকেও প্রথম মেয়াদে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলতে হয় আইভীকে।

২০১৪ সালের নির্বাচনে অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরীকে বাদ দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে শামীম ওসমানকে মনোনয়ন দেয়। একতরফা এই নির্বাচনে এমপি হয়ে নারায়ণগঞ্জে নিজের ভিত্তি আরও শক্তিশালী করেন শামীম ওসমান।

গত কয়েক বছরে নারায়ণগঞ্জে স্কুলছাত্র ত্বকী হত্যাসহ চাঞ্চল্যকর সাত খুনে ওসমান পরিবারের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল ওঠে।

ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, উনষত্তরের গণ-অভ্যুত্থানসহ সব প্রগতিশীল আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকে যে পরিবারটির উত্থান দুই পুরুষ বাদে নিজেদের কর্মকাণ্ডের কারণেই তাদের সম্মান আজ ভূলুন্ঠিত। বলা হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ নিজের ক্ষতি নিজেই না করে ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ তার ক্ষতি করতে পারে না। নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবার উত্থান ও পতন তারই দৃষ্ঠান্ত।

ভাষান্তর: আবু সাদিক








নাম

অর্থ ও বাণিজ্য,235,আন্তর্জাতিক,731,কাপাসিয়া,342,কালিয়াকৈর,417,কালীগঞ্জ,253,খেলা,644,গাজীপুর,3936,চাকরির খবর,33,জয়দেবপুর,1581,জাতীয়,2958,টঙ্গী,911,তথ্যপ্রযুক্তি,512,ধর্ম,196,পরিবেশ,136,প্রতিবেদন,310,বিজ্ঞান,55,বিনোদন,697,ভিডিও,58,ভিন্ন খবর,142,ভ্রমন,115,মুক্তমত,27,রাজধানী,829,রাজনীতি,1055,লাইফস্টাইল,283,শিক্ষাঙ্গন,398,শীর্ষ খবর,10757,শ্রীপুর,481,সাক্ষাৎকার,12,সারাদেশ,649,স্বাস্থ্য,212,
ltr
item
GazipurOnline.com: ওসমান পরিবারের উত্থান, পতন
ওসমান পরিবারের উত্থান, পতন
https://4.bp.blogspot.com/-Kqa0sj7i6fM/WmSVtnV4kQI/AAAAAAAAWGE/C_NuaS3DjDIKzkJB_zDZwxTyoKms62rXgCLcBGAs/s400/shamim-osman-threatens.jpg
https://4.bp.blogspot.com/-Kqa0sj7i6fM/WmSVtnV4kQI/AAAAAAAAWGE/C_NuaS3DjDIKzkJB_zDZwxTyoKms62rXgCLcBGAs/s72-c/shamim-osman-threatens.jpg
GazipurOnline.com
https://www.gazipuronline.com/2018/01/osman-paribar.html
https://www.gazipuronline.com/
https://www.gazipuronline.com/
https://www.gazipuronline.com/2018/01/osman-paribar.html
true
13958681640745950
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Read More Reply Cancel reply Delete By প্রচ্ছদ PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share. STEP 2: Click the link you shared to unlock Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy