
গাজীপুরের কালীগঞ্জ বাজারে কয়েক বছর আগেও জুতার দোকান ছিল সুজন সরকারের (৩৮)। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা ছাড়া সেই সুজন সরকার এখন সর্বরোগের ডাক্তার।
কালীগঞ্জ বাজারের কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে রয়েছে তাঁর চেম্বার-কাম-ওষুধের দোকান। করেন ছোটখাটো অপারেশনও। তাঁর ভুল চিকিৎসা ও প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সুস্থ হওয়ার পরিবর্তে রোগীদের আরো বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে।
সুজন পাশের নরসিংদীর পলাশ উপজেলার কাজৈর গ্রামের ইদ্রিস সরকারের ছেলে। কয়েক বছর ধরে তিনি বাড়ি করে কালীগঞ্জ পৌর এলাকার দড়িসোম গ্রামে বসবাস করছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিকও পাস না করলেও দোকানের সাইনবোর্ডে নামের আগে লিখে রেখেছেন ‘ডাক্তার’ শব্দটি। মূলত অশিক্ষিত ও দরিদ্র মানুষজন জটিলসহ সর্বরোগের বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত সুজন ডাক্তারের রোগী। তাঁর কাছে ওষুধও পাওয়া যায় সর্বরোগের। বিপদ এড়াতে তিনি ‘সরকার মেডিক্যাল হল’ নামের ওষুধের দোকানের দুটি শাটারের একটি সব সময় বন্ধ রাখেন। ফি নিলেও রোগীদের ব্যবস্থাপত্র দেন না। শুধু ওষুধের প্যাকেটের গায়ে নিয়মকানুন লিখে দেন। তাঁর ফি অন্য ডাক্তারদের মতো নির্দিষ্ট নয়। রোগীর আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী ফি ও ওষুধের মূল্যের রয়েছে বিভিন্ন প্যাকেজ। তিনি মাঝেমধ্যে হাতে তুলে নেন কাঁচি-সুই-সুতা। করে ফেলেন ছোটখাটো অপারেশন।
কালীগঞ্জ বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, বছর দশেক আগে বর্তমান ওষুধের দোকানের পেছনের অংশে ইদ্রিস সরকার ওষুধ বিক্রি করতেন। সামনের অংশে জুতা বিক্রি করতেন সুজন। ছয়-সাত বছর আগে বাবার মৃত্যু হলে জুতার ব্যবসা গুটিয়ে ওষুধের দোকানের হাল ধরেন ছেলে। মাত্র তিন-চার বছরের মাথায় তিনি হয়ে ওঠেন সব রোগের ডাক্তার। অবশ্য তাঁর ডাক্তার হয়ে ওঠা এবং রোগী পাওয়ার পেছনে রয়েছে একটি দালালচক্র। উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে রোগী সংগ্রহ করে তাঁর কাছে নিয়ে আসে দালালরা। বিনিময়ে পায় নির্দিষ্ট কমিশন। রোগীদের একটি বড় অংশ আসে শরীর মোটা করতে। এ কারণে তাঁর দোকানে সব সময় ভিড় লেগে থাকে।
কালীগঞ্জ পৌরসভার মুনশুরপুরের (টেকপাড়া) রাজমিস্ত্রি মো. জামান মিয়া (৩৯) জানান, দুই-তিন বছর আগে জ্বরে আক্রান্ত হলে পরিবারের লোকজন তাঁকে সুজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। সেখানে গেলে একটি ইনজেকশন এবং কিছু ওষুধ দিয়ে এক হাজার ৩০০ টাকা বিল রাখা হয়। অসুখ না কমে এক দিন পর তাঁর কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়। পুনরায় সুজন ডাক্তারের কাছে গেলে আরো কিছু ওষুধ দিয়ে এক হাজার ৭০০ টাকা বিল রাখা হয়। পরে অবস্থা আরো খারাপ হলে তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করানো হয়। এ জন্য ব্যয় করতে হয়েছে ৫২ হাজার টাকা। সঙ্গে ছয় মাস বিছানায় থাকতে হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কালীগঞ্জ বাজারের একজন ব্যবসায়ী জানান, দড়িসোম গ্রামের বেদে পল্লীর মো. মোস্তফা মিয়ার স্ত্রী মমতাজ বেগম (৩০) সন্তানসম্ভাবনা হলে চার মাস আগে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে তাঁর এমআর (গর্ভপাত) করা হয়। ক্লিনিকের চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে ওষুধ লিখে দেন। ওষুধের দাম বেশি থাকায় স্বজনরা মমতাজকে সুজন ডাক্তারের ফার্মেসিতে নিয়ে যায়। কম দামের ওষুধ দেওয়ার কথা বলে ইনজেকশন পুশ করে সুজন। ইনজেকশন দেওয়ার পর অবস্থা খারাপ হলে রোগীকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি আরো জানান, উঠতি বয়সের তরুণদের উত্তেজক এবং চিকনদের মোটা হওয়ার ওষুধ দিয়ে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে ফেলেছেন সুজন। তাঁর কাছে আসা বেশির ভাগ রোগী নিরক্ষর। তাদের সরলতার সুযোগ নিয়ে ভুল চিকিৎসা দিয়ে প্রতারণা করছেন সুজন।
পলাশ উপজেলার ইসলামপাড়ার মৃত শরীফ হোসেনের স্ত্রী আসমা বেগম (৩৪) জানান, তিন মাস আগে মেয়ে সানজিদা আক্তার (১২) অসুস্থ হলে সুজনের কাছে নিয়ে যান। চিকিৎসার পর সুস্থ হওয়া তো দূরের কথা আরো তাঁদের ভোগান্তি বেড়ে যায়।
অভিযুক্ত সুজন সরকার বলেন, ‘আমার বাবা এ ফার্মেসির মালিক ছিলেন। বাবা মারা যাওয়ার পর আমিই চিকিৎসা করছি।’ অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। পল্লী চিকিৎসক হিসেবে দাবি করলেও প্রমাণ দেখাতে পারেননি। দোকানের ড্রাগ লাইসেন্স আছে কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘এসব লাগে না।’
কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ ছাদেকুর রহমান আকন্দ বলেন, ‘সরকার ফার্মেসির বিরুদ্ধে অভিযোগের কথা এর আগেও শুনেছি। খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেব।’
কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার মু. মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘এমন চিকিৎসার বিষয় জানা ছিল না। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’