
১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ মুক্তিযুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরে। স্বাধীনতা সংগ্রামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম এই সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের পর দেশজুড়ে মুক্তিকামী জনতার স্লোগান ওঠে ‘জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। সেদিন পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন গাজীপুরের নেয়ামত আলী, মনু খলিফা ও হুরমত আলী। আহত হন শতাধিক এলাকাবাসী। পরে গুরুতর আহত কানুবীরও চিকিৎসাধীন মারা যান। দিনটিকে জাতীয়ভাবে পালনসহ শহীদদের পরিবারের সদস্যদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় এলাকাবাসী।
দিনটি স্মরণ ও অপর দুটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে দুই দিনের সফরে আজ সোমবার গাজীপুর আসছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। তিনি প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর ও শহীদদের স্মরণে নাগরিক সংবর্ধনা, কারা সপ্তাহ উদ্বোধন ও গাজীপুরের ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) দ্বিতীয় সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। প্রতিবছরের মতো এবারও ১৯ মার্চ গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় স্মরণ করেন এলাকাবাসী।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, দুই দিনের সফরে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ১৯ মার্চ বিকালে হেলিকপ্টারে গাজীপুর পৌঁছবেন। বিকাল ৩টায় তাকে গাজীপুর সার্কিট হাউসে গার্ড অব অনার দেওয়া হবে। বিকাল ৪টায় তিনি ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ গাজীপুরে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর ও শহীদদের স্মরণে নাগরিক গণসংবর্ধনায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। তিনি গাজীপুর সার্কিট হাউসে রাত যাপন করবেন। পরদিন দুপুর ১২টায় কারা সপ্তাহ ২০১৮-এর উদ্বোধন উপলক্ষে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার প্রাঙ্গণে আয়োজিত কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও সালাম গ্রহণ করবেন। একই দিন বিকাল ৩টায় রাষ্ট্রপতি গাজীপুরের ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। এ ছাড়া ৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাজীপুর আসার কথা রয়েছে। রাষ্ট্রপতির আগমন উপলক্ষে গাজীপুর শহরজুড়ে ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে। দিনরাত সড়ক মেরামত, ভবন রঙ ও চুনকামসহ নগরে চলছে সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ। নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা। এরই মধ্যে পুলিশ প্রশাসন ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা ইভেন্টের স্থান পরিদর্শন করেছেন।
বীরত্বগাথা সেই দিন ১৯ মার্চ : মার্চের প্রথম দিকে দুই ধাপে জয়দেবপুর মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। মরহুম হাবিব উল্লাহ এমপির নেতৃত্বে প্রয়াত মণিন্দ্রনাথ কুমার গোস্বামী ও শ্রমিক নেতা মরহুম এমএ মুত্তালিবকে সদস্য করে ৩ সদস্যের হাইকমান্ড এবং বর্তমান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপিকে আহ্বায়ক করে অ্যাকশন কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির কোষাধ্যক্ষ ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মো. নজরুল ইসলাম খান এবং সদস্য ছিলেন মো. শহীদুল্লাহ বাচ্চু (মরহুম), শেখ মো. আবুল হোসাইন, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার মিয়া, হারুন আর রশিদ ভূঁইয়া, মো. শহীদুল ইসলাম পাঠান (মরহুম) ও মো. নুরুল ইসলাম। গাজীপুরের তৎকালীন নাম ছিল জয়দেবপুর। জয়দেবপুরের ভাওয়াল রাজবাড়ীতে অবস্থান ছিল তৎকালীন পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের।
সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার মিয়া জানান, ১৯ মার্চ সকালে ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব এক কোম্পানি সৈন্যসহ জয়দেবপুর সেনানিবাসে এসে উপস্থিত হন। এ সময় ওই রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিকদের নিরস্ত্র করা হবে এমন সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে এলাকায়। ফলে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে মুক্তিকামী সর্বস্তরের বীর জনতা। জনতার সঙ্গে ছিল লাঠিসোটা, তীর-ধনুক, বল্লম, রড আর শাবল। জনতা রাজবাড়ী সড়কে তৈরি করে দুর্ভেদ্য অবরোধ। তারা রেলস্টেশন থেকে মালগাড়ির একটি ওয়াগন এনে রাস্তা বন্ধ করে দেয়। সংগ্রাম পরিষদের ডাকে রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দেয় বীর জনতা। পাকিস্তানি বাহিনী জয়দেবপুর বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সামনে পৌঁছলে জনতা তাদের কাছ থেকে ৪টি চাইনিজ রাইফেল ও একটি স্টেনগান কেড়ে নেয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলি চালায়। মরহুম কাজী আজিম উদ্দিন মাস্টারের ব্যক্তিগত বন্দুক দিয়ে পাল্টা গুলি চালানো হয়। সেদিন পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিকামী জনতার লড়াইয়ে শহীদ হন নেয়ামত আলী, মনু খলিফা ও হুরমত আলী।
এদিকে জয়দেবপুর বটতলা ব্যারিকেড ভেঙে ঢাকায় যাওয়ার পথে পাকিস্তানি সেনারা চান্দনা চৌরাস্তায়ও শক্ত প্রতিরোধের মুখে পড়ে। এখানেও পাকিস্তানি সেনারা নির্বিচারে গুলি চালায়। এ সময় ভোগড়া গ্রামের সাহসী যুবক ফুটবলার হুরমত আলী এক পাকিস্তানি সেনার রাইফেল ছিনিয়ে নিতে গিয়ে অপর এক সেনার গুলিতে শহীদ হন। এ সময় কানুবীরসহ অনেকে আহত হন। এর পরই দেশজুড়ে স্লোগান ওঠে ‘জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। পরে চিকিৎসাধীন কানুবীরও মারা যান।
দিবসটি জাতীয়ভাবে পালনের দাবি : বছর ঘুরে ১৯ মার্চ এলে গভীর শ্রদ্ধা আর নানা আয়োজনে মেতে ওঠেন গাজীপুর নগর ও জেলাবাসী। কিন্তু প্রথম প্রতিরোধ সংগ্রামে সেদিন যাদের রক্তে স্বাধীনতা যুদ্ধ গতি পায়, তাদের পরিবারের সদস্যদের এখনো রয়েছে নানা কষ্ট আর আকুতি। সেদিনের নেতৃত্ব দেওয়া যোদ্ধাদেরও রয়েছে নানা দাবি।
শহীদ নেয়ামতের বড় ভাই কেরামত আলীর অভিযোগ, স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও তাদের দৈন্যদশা কাটেনি। এখনো টিকে আছে শহীদ নেয়ামত আলীর রেখে যাওয়া মাটির ঘর।
তিনি আরও জানান, ১৯ মার্চ জয়দেবপুরের মারিয়ালি এলাকা থেকে তার ভাই নেয়ামতসহ গ্রামের বীর জনতা প্রতিরোধস্থলে যান মিছিল নিয়ে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে চোখের সামনেই শহীদ হন নেয়ামত। তার দাফন হয়েছে পারিবারিক কবরস্থানে। শহীদ মনু খলিফাকেও দাফন করা হয় একসঙ্গে। কবরস্থানটিতে বর্তমান সরকার সীমানাপ্রাচীর তৈরি করলেও পুরোপুরি সুরক্ষিত করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
তৎকালীন মুক্তি সংগ্রাম পরিষদের সদস্য আব্দুস সাত্তার মিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সেদিন বীর বাঙালি পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরও দিনটিকে জাতীয়ভাবে পালন করা হচ্ছে না। তিনি বীরত্বগাথা দিনটিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পালনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে জোর দাবি জানান। একই সঙ্গে শহীদ পরিবারের সদস্যদের যথাযথ সম্মান দেওয়ার আহ্বান জানান।
শহীদ পরিবারের সদস্যরা জানান, স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও শহীদদের স্বজনদের দিন কাটছে নানা কষ্টে। শহীদ পরিবারের নামে জমি বরাদ্দ করা, সুবিধা প্রদানসহ রয়েছে নানা দাবি। অবশ্য ১৯ মার্চের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে চান্দনা চৌরাস্তায় নির্মাণ করা হয়েছে স্মারক ভাস্কর্য ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ এবং জয়দেবপুর বটতলায় ‘মুক্তমঞ্চ’।
১৯৭১ সালের সেদিনের ওই প্রতিরোধ সংগ্রামে নেতৃত্বে দেন আজকের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপি। তার কাছেই এখন জাতীয়ভাবে দিবসটি পালনসহ নানা দাবি শহীদ পরিবারের লোকজন ও মুক্তিযোদ্ধাদের।
এ বিষয়ে আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ১৯ মার্চ জাতীয়ভাবে পালনের জন্য যে দাবি উঠেছে, সে দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে আজকে দেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি সদয় সম্মতি দিয়েছেন ১৯ মার্চ গাজীপুরে এসে গাজীপুরবাসীর গৌরবগাথা-বীরত্মপূর্ণ যুদ্ধকে স্বীকৃতি দেওয়ার। এর মাধ্যমে সারা দেশে ভবিষ্যতে ১৯ মার্চ জাতীয়ভাবে পালনের প্রক্রিয়া শুরু হবে।