কোটা প্রথার সংস্কার চান, বিলোপ নয়

দেশে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির সংস্কার নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে চলা বাদানুবাদ অনেক দিনের। চাকরিতে যোগ্যতার মানদণ্ডে উপরের সারিতে থেকেও কোটার মারপ্যাঁচে ছিটকে পড়ছেন অনেক মেধাবী তরুণ-তরুণী। সেখানে স্থান করে নিচ্ছেন অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা। সরকারি চাকরির ১০০টি পদের ৫৫টি বিভিন্ন কোটায় সংরক্ষিত। এর মধ্যে ৩০ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ ভাগ জেলা, ১০ ভাগ নারী এবং ৫ ভাগ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষিত। মেধাভিত্তিক নিয়োগের সুযোগ মাত্র পাচ্ছে ৪৫ ভাগ সাধারণ চাকরি প্রার্থী।

সরকারি নিয়োগে কোটাবৈষম্য নিরসনের দাবিতে রাজপথে নেমেছে শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রার্থীরা। তাদের প্রতি সমর্থন যেমন আছে, তেমনি তাদের দাবির বিরোধিতাকারীর সংখ্যাও কম নয়। দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা কোটা প্রথাকে কীভাবে দেখছেন, আসুন চোখ রাখি।

১০ ভাগের বেশি কোটা থাকা ঠিক নয় : অধ্যাপক  আনিসুজ্জামান

প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক  আনিসুজ্জামান মনে করেন সরকারি চাকরিতে ১০ ভাগের বেশি কোটা সংরক্ষণ করা উচিত না। বিদ্যমান ব্যবস্থায় যে ৫৬ ভাগ  কোটা রয়েছে তা অন্যায়। তবে কোটা সংস্কারের নামে কোনো সহিংস আন্দোলন গ্রহণযোগ্য নয়। আলাপ- আলোচনার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। গতকাল মানবজমিনকে তিনি বলেন, রোববার যা দেখলাম তাতে মনে হচ্ছে আন্দোলন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। সব সময় শুভ বুদ্ধি জাগ্রত রাখা দরকার।

কোটার কারণে দেশের মেধাবীরা আজ বিপন্ন : আকবর আলি খান

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও  তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খান সরকারি চাকরিতে নিয়োগে এই কোটা পদ্ধতিকে ‘উদ্ভট’ আখ্যায়িত করে  বলেন, পৃথিবীর এমন কোনো দেশ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে কোটা মেধাকে ছাপিয়ে যেতে পারে। আমরা পারছি। অর্থাৎ উল্টো যাত্রায় প্রথম। কোনো দেশেই অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য কোটা ব্যবস্থা চালু রাখার নিয়ম নেই। কোটার কারণে দেশের মেধাবীরা আজ বিপন্ন। কোটা বন্ধ হলে অনেক মেধাবীই চাকরি পাবে। তাই বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা অবশ্যই সংস্কার হওয়া উচিত।

কোটা পদ্ধতিকে বাদ দেয়া যাবে না : আরেফিন সিদ্দিক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলছিলেন, কোটা পদ্ধতিকে বাদ দেয়া যাবে না। কারণ সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সামনে দিকে নিয়ে আসতে হবে এ কোটা পদ্ধতি দিয়েই। সমাজে ডিস্ক্রিমিনেশনকে নেগেটিভলি দেখা হয়। তবে এই কোটা হচ্ছে পজেটিভ ডিস্ক্রিমিনেশন। আমরা এ ডিস্ক্রিমিনেশটকা পজেটিভলি করি। কারণ এর মাধ্যমে সমাজে পিছিয়ে পড়া মানুষকে একটি তুলনামূলক অবস্থানে নিয়ে আসতে পারি। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশ এই কোটা পদ্ধতির মাধ্যমেই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সামনে নিয়ে এসেছেন আসছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পরে এই কোটা পদ্ধতি শুরু করেছিলেন। এর মাধ্যমে সমাজে নারীদের সামনের কাতারে নিয়ে আসা গেছে। আদিবাসীদের একটি তুলনামূলক অবস্থানে আনার জন্য। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় কোটার পরিমাণ বেড়েছে ও কমেছে। তবে এখন একটি পর্যায়ে এসেছে এ পদ্ধতি নিয়ে নতুন করে ভাবার।

কোটা একদম তুলে দেয়ার পক্ষে নই : ড. এ কে আজাদ চৌধুরী

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলছিলেন, আমি সাধারণত কোটা ব্যবস্থার পক্ষে নই। সব কিছু মেধার ভিত্তিতেই হওয়া উচিত। তবে মুক্তিযোদ্ধা সন্তান, অনগ্রসর জাতি এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী সব মিলিয়ে দশ শতাংশ কোটা থাকতে পারে। এটা যদি হয় তাহলে আমি এর পক্ষে। তবে কোটা একদম তুলে দেয়ার পক্ষে নই। কেননা তা হলে ইতিহাসকে অস্বীকার করা হবে। মানবতাকে অস্বীকার করা হবে। মানবিক মূল্যবোধকে অস্বীকার করা হবে।, মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছে তাদের সন্তান বা বংশধর তাদের জন্য একটা টোকেন কোটা থাকা উচিত। আর অনগ্রসর সম্প্রদায়ের জন্যও একটি টোকেন কোটা ব্যবস্থা থাকতে পারে। আর একটি হলো যারা শারীরিকভাবে অসচ্ছল বা প্রতিবন্ধী তাদের জন্য এক-দুই শতাংশ কোটা ব্যবস্থা থাকতে পারে। বিশ্বের সব জায়গাই এদের জন্য কোটা ব্যবস্থা রয়েছে। এসব মিলিয়ে দশ শতাংশ কোটা ব্যবস্থা থাকতে পারে।

সংস্কার নিয়ে আন্দোলন অত্যন্ত যৌক্তিক: মুহম্মদ জাফর্ ইকবাল

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেছেন, শিক্ষার্থীরা যে কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন করছে তা অত্যন্ত যৌক্তিক। সরকারের উচিত তাদের দাবি মেনে নিয়ে কোটা কাঠামোর সংস্কার করা। বর্তমানে মেধাবীদের থেকে বিভিন্ন জায়গায় কোটাপ্রাপ্তদের সংখ্যা বেশি। চাকরির ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশ থেকে শুরু করে এর অধিক কোটা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়। এই অনুপাতটাকে কমিয়ে আনা প্রয়োজন। তা না হলে মেধাবীদের মূল্যায়ন হবে না। তবে মনে রাখতে হবে, আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের জীবনের কথা না ভেবে আমাদের একটি দেশ উপহার দিয়েছেন। অথচ তারাই একটা বিরাট সময় ধরে অবহেলিত ছিলেন। তাদের জীবনযাত্রার মান সবার থেকে ভালো হোক আমরা সবাই চাই।

মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল চেয়ে তাদের অবমাননা করা হচ্ছে: সেলিম রেজা
সাধারণ সম্পাদক, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড

মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের সাধারণ সম্পাদক সেলিম রেজা বলেন,  কোটা ব্যবস্থার সংস্কার আমরাও চাই। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সন্তানদের কোটা বাতিলের দাবির বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান। কারণ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে এই কোটা মুক্তিযোদ্ধাদের উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাতে সপরিবারে হত্যার পর এই কোটা বাতিল করা হয়। ২৪ বছর মুক্তিযোদ্ধাদের এই কোটা দেয়া হয়নি। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানদের জন্য আবার কোটা চালু হয়। ২৪ বছর যদি কোটা বন্ধ না রাখা হতো তাহলে এখন আর মুক্তিযোদ্ধা কোটার প্রয়োজন থাকত না। আমাদের যে বঞ্চিত করা হয়েছে তাতো পুষিয়ে দিতে হবে। মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল চেয়ে যারা মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননা করা হচ্ছে।

প্রাথী পাওয়া না গেলে মেধাতালিকা থেকে নিয়োগের সুযোগ আছে :মোজাম্মেল হক
সিনিয়র সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোজাম্মেল হক খান, সরকারি চাকরিতে বিভিন্ন কোটায় সংরক্ষিত পদে যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে মেধা তালিকায় থাকা প্রার্থীদের মধ্য থেকে সেসব পদ পূরণ করা হবে। এর বাইরে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের আপাতত কোনো সম্ভবনা নেই। আর সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর কোনো চিন্তাভাবনাও এখন করা হচ্ছে না। কোটার ভিত্তি কিছু   পদ সংরক্ষিত আছে, থাকবে।  কিন্তু যদি তাদের মধ্য থেকে উপযুক্ত প্রার্থী না পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে মেধা তালিকায় যারা ওপরের দিকে থাকবে তাদের দ্বারা এই পদ পূরণ করা যাবে। তাদের কোটাটাও বহাল আছে, আবার মেধাবিরাও যাতে সেখানে বঞ্চিত না হয়। এখন যেই ব্যবস্থাটা নেওয়া হয়েছে, এটা দুইটার একটা সহজ সমাধান, নিষ্পত্তি। অর্থাৎ কোনো পক্ষই এতে হার্ট (আঘাত) হওয়ার সুযোগ নাই। কোনো পক্ষ বঞ্চিত হচ্ছে না। মেধার মর্যাদাও পাচ্ছে। আবার কোটার প্রতি সম্মান অক্ষুণ্ণ থাকছে। অর্থাৎ সেখান থেকেও সরকার সরে আসেনি। আমি মনে করি, এটা সবার জন্য গ্রহণযোগ্য একটি ব্যবস্থা।








নাম

অর্থ ও বাণিজ্য,235,আন্তর্জাতিক,731,কাপাসিয়া,342,কালিয়াকৈর,417,কালীগঞ্জ,253,খেলা,644,গাজীপুর,3936,চাকরির খবর,33,জয়দেবপুর,1581,জাতীয়,2958,টঙ্গী,911,তথ্যপ্রযুক্তি,512,ধর্ম,196,পরিবেশ,136,প্রতিবেদন,310,বিজ্ঞান,55,বিনোদন,697,ভিডিও,58,ভিন্ন খবর,142,ভ্রমন,115,মুক্তমত,27,রাজধানী,829,রাজনীতি,1055,লাইফস্টাইল,283,শিক্ষাঙ্গন,398,শীর্ষ খবর,10757,শ্রীপুর,481,সাক্ষাৎকার,12,সারাদেশ,649,স্বাস্থ্য,212,
ltr
item
GazipurOnline.com: কোটা প্রথার সংস্কার চান, বিলোপ নয়
কোটা প্রথার সংস্কার চান, বিলোপ নয়
https://2.bp.blogspot.com/-FGlRTfKENns/WsylrC6XkjI/AAAAAAAAX3E/ANTZNZWlZZ8qjZd304BkKf0F58zWKXnCwCLcBGAs/s400/kota.jpg
https://2.bp.blogspot.com/-FGlRTfKENns/WsylrC6XkjI/AAAAAAAAX3E/ANTZNZWlZZ8qjZd304BkKf0F58zWKXnCwCLcBGAs/s72-c/kota.jpg
GazipurOnline.com
https://www.gazipuronline.com/2018/04/kota828.html
https://www.gazipuronline.com/
https://www.gazipuronline.com/
https://www.gazipuronline.com/2018/04/kota828.html
true
13958681640745950
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Read More Reply Cancel reply Delete By প্রচ্ছদ PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share. STEP 2: Click the link you shared to unlock Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy