
সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এমপিদের প্রচারের সুযোগ দিয়ে আচরণ বিধিমালা সংশোধন নিয়ে নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে দ্বিধা-বিভক্তি দেখা দিয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ‘সিটি কর্পোরেশন (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা, ২০১৬’ এ সংশোধনী আনার লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত কমিশন সভায় এ সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে আচরণ বিধিমালায় কী ধরনের সংশোধনী আনা যায় তা পর্যালোচনা করে রিপোর্ট দিতে নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানমের নেতৃত্বাধীন আইন সংস্কার কমিটিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
এদিকে এমপিদের প্রচারের সুযোগ দেয়ার বিষয়টি ইতিবাচকভাবে কমিশন দেখছে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ।
তিনি জানান, বৈঠকে বিএনপির দাবিদাওয়া নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। গতকাল ইসিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার সভাপতিত্বে ইসির এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় চার কমিশনার ও ইসির উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। আচরণ বিধি সংশোধন প্রসঙ্গে কমিশন সভার আলোচনার বিষয়ে ইসি সচিব বলেন, আচরণ বিধিমালার সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কারা তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সিটি কর্পোরেশন বড় এলাকা গঠিত। পৌরসভা ও ইউপি ছোট এলাকা নিয়ে গঠিত। অনেক সংসদ সদস্য সিটি এলাকায় বসবাস করে থাকেন, যাওয়া আসা করে থাকেন। স্বাভাবিকভাবে নির্বাচনের তফসিল হলে তাদের নিজ এলাকায় যাওয়া আসাটা অনেকটা বন্ধ হয়ে যায়। আচরণ বিধিতে বলা আছে শুধুমাত্র ভোটের দিন ভোট দিতে যেতে পারবেন। অন্য সময় যেতে পারবেন না। যার ফলে সংসদ সদস্যদের নিজের এলাকার বাইরে থাকতে হয়। সেদিক বিবেচনা করে আলোচনাটা হয়েছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে সংসদ সদস্যরা অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির আওতায় আছেন। নির্বাচন হলে সিটি করপোরেশনের মতো বিরাট এলাকায় অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বাইরে থাকতে হয়। এ বিষয়টি বিবেচনা করেই সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে আলোচনাটা হয়েছে। সংসদ সদস্যরা সরকারি কোনো অফিস হোল্ড করেন না। ওনারা কোনো সরকারি গাড়ি ব্যবহার করেন না। তাই তারা কোনো অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কি না বা সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কি না তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কবিতা খানমের নেতৃত্বে আইন ও বিধিমালা সংস্কারে যে কমিটি রয়েছে, সেই কমিটি বিষয়টি পর্যালোচনা করে রিপোর্ট দেবেন। এরপরে বিষয়টি কমিশনে উত্থাপন করবেন। এ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বৈঠকে অংশ নেয়া একাধিক কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার শর্তে জানান, এমপিদের প্রচারের সুযোগ দিয়ে আচরণ বিধিমালা সংশোধনের পক্ষে একাধিক নির্বাচন কমিশনার ও ইসির কর্মকর্তারা বক্তব্য রাখেন। তাদের কেউ কেউ এ বিধিমালাকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেও বৈঠকে মন্তব্য করেন।
অপরদিকে সংশোধনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে একজন কমিশনার বৈঠকে বলেন, এ পর্যায়ে বিধিমালা সংশোধন করা হলে কমিশনের ভাবমূর্তি নিয়ে কথা উঠবে। এমনকি কমিশনের স্বাধীনতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে।
আরেকজন কমিশনার বলেন, আচরণ বিধিমালায় আরও কয়েকটি জায়গায় অসঙ্গতি রয়েছে, সংশোধন করলে সবজায়গায় একসঙ্গেই সংশোধন করা দরকার।
বৈঠকে বিগত কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ কমিশন এ সংক্রান্ত বিধি-বিধান সংশোধনের উদ্যোগ নিলেও তা কী কারণে হয়নি সে বিষয়েও বক্তব্য রাখেন ইসির কর্মকর্তারা। সোস্যাল মিডিয়ায় প্রচারের বিষয়টি আচরণ বিধিতে অন্তর্ভূক্তি নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়। বিধি সংশোধন নিয়ে কমিশনারদের দুই পক্ষের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আচরণ বিধিমালা পর্যালোচনার জন্য আইন সংস্কার কমিটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয় বলে জানান তারা। বিধিমালা সংশোধন নিয়ে ইসি সচিব আরও বলেন, আচরণ বিধিতে কি কি সংশোধন আসতে পারে তা আইন সংস্কার কমিটি একটি প্রস্তাব দেবে। এজন্য কমিটিকে কোনো সময় বেধে দেওয়া হয়নি। দ্রুত সম্ভব প্রস্তাব দিতে বলা হয়েছে। তফসিল ঘোষণার পর বিধিমালা সংশোধনের এই উদ্যোগ কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, আচরণ বিধি মাঝেমধ্যে আপডেট করা লাগে। আগে দলীয় প্রতীকে হতো না, এখন দলীয় প্রতীকে হচ্ছে। তখন এক ধরণের প্রেক্ষাপট, এখন আরেক ধরণের প্রেক্ষাপট। স্বাভাবিকভাবে এমপিরা এলাকায় যেতে পারেন না। এটা আপডেট করার জন্য আলোচনা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের চাপে কি এই উদ্যোগ কি না এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, চাপে না। যেকোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনের স্টেক হোল্ডার। তাদের নিয়ে কাজ করতে হয়। তাদের নিয়ে পরামর্শ করে আলাপ আলোচনা করে তাদের সুবিধা অসুবিধাগুলো আমরা বিবেচনা করি। আবেদন নিবেদন করলে ইসি বিষয়গুলো বিবেচনা করে।
বিএনপির দেয়া প্রস্তাবের বিষয়ে তিনি বলেন, কমিশন সভায় বিএনপির প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়নি। তাদের প্রস্তাব নিয়ে কমিশন সভা হবে কী না তা এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। হয়ত হতে পারে। আজকের বৈঠকে এটা নিয়ে আলোচনা হয়নি। অপর এক প্রস্তাবের জবাবে সচিব বলেন, গাজীপুর ও খুলনা সিটি নির্বাচনে সংশোধিত আচরণ বিধিমালা প্রয়োগ হবে কি না তা নিয়ে আলোচনা হয়নি। এটা প্রস্তাব, বিবেচনা করা হচ্ছে। আসন্ন নির্বাচনে ইমপ্লিমেন্ট হতেও পারে নাও হতে পারে।
প্রসঙ্গত: গত ১৩ এপ্রিল ইসিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও অন্য কমিশনারদের সঙ্গে বৈঠক করে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এমপিদের প্রচারের সুযোগ দিতে আচরণ বিধি সংশোধনের দাবি জানান। ওই সময়ে তারা সংসদীয় আসনের সীমানা পুননির্ধারণ ও জাতীয় সংসদের নির্বাচনী আইন ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২’ সংশোধন নিয়েও কথা বলেন। এরপরই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে লেভেল প্লেইং ফিল্ড তৈরিসহ বিভিন্ন দাবি নিয়ে ইসিতে যান।