দেশজুড়ে মাদকবিরোধী অভিযান চালাচ্ছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। গত ১৭ দিনে ৪৯৯টি অভিযান চালিয়ে ৫২৬ জন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছ। উদ্ধার করেছে প্রায় ২০ কোটি ৩০ লাখ টাকার মাদকদ্রব্য। মাদকবিরোধী অভিযানে র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ১৩ জন মাদক ব্যবসায়ী। নিহত সবাই শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী বলে জানিয়েছে র্যাব।
এদিকে যার যার অবস্থান থেকে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার আহ্বান জানিয়েছেন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। গতকাল রবিবার দুপুর ২টার দিকে রাজধানীর গুলিস্তানের মুক্তাঙ্গনে র্যাব আয়োজিত মাদকবিরোধী প্রচার অভিযানে অংশ নিয়ে তিনি একথা বলেন।
‘চল যাই যুদ্ধে মাদকের বিরুদ্ধে’ এই স্লোগান সামনে রেখে বিশেষ প্রচার অভিযান শুরু করেছে এলিট ফোর্স র্যাব। এ বিষয়ে বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘আমরা যেভাবে জঙ্গিবাদ দমন করেছি সবার সহায়তায়, আমি বিশ্বাস করি প্রত্যেকে তার অবস্থান থেকে মাদকবিরোধী যুদ্ধে নামলে এ ক্ষেত্রেও আমরা সফল হবো।’
র্যাব সূত্রে জানা গেছে, গত ৩ মে র্যাবের ১৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকের বিরুদ্ধে র্যাবকে সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দেন। এরপর গত ৪ মে থেকেই র্যাব বিশেষ অভিযান শুরু করে। গতকাল রবিবার পর্যন্ত সারাদেশে র্যাবের প্রায় ৪৯৯টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে ২ হাজার ৪৫১ জনকে। এর মধ্যে ২ হাজার ৪৪ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও ৪০৭ জনকে ২৯ লাখ ৮৯ হাজার ৯৫০ টাকা জরিমানা করেছে। তবে মূল অভিযান শুরু হয়েছে গত ১৪ মে সোমবার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে। ওই ঘোষণার পর থেকে এখন প্রায় প্রতিদিনই বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটছে। ওইদিন রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠিনতর ব্যবস্থা নেওয়ার আভাস দেন র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। সেদিন তিনি বলেন, মাদক প্রতিরোধে আইনি ব্যবস্থায় যত কাঠামো আছে, তার সর্বোচ্চ প্রয়োগ করবে র্যাব। ওই সময় তিনি কারও কাছে মাদক থাকলে তা র্যাবের ক্যাম্পের পাশে ফেলে যাওয়ার অনুরোধও জানান।
র্যাব সূত্র জানায়, মাদকবিরোধী অভিযান চালানোর সময় সর্বশেষ গত শনিবার গভীর রাত থেকে রবিবার ভোর পর্যন্ত চার জেলা ময়মনসিংহ, ফেনী, দিনাজপুর ও যশোর এ পৃথক বন্দুবযুদ্ধে আরও চার মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছে।
পুলিশের বরাত দিয়ে ময়মনসিংহ ব্যুরো জানায়, শনিার দিবাগত রাত সোয়া ২টার দিকে ময়মনসিংহের মাসকান্দা এলাকার গনশার মোড়ে গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে (ডিবি) ‘বন্দুকযুদ্ধে’ রিয়াজুল ইসলাম বিপ্লব (৪০) নামে একজন নিহত হয়। পুলিশ বলছে, বিপ্লব ওই এলাকার একজন শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী।
ময়মনসিংহ সদর থানার ওসি আশিকুর রহমান জানান, কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ী মাসকান্দা এলাকায় জড়ো হয়ে একটি চালান নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করছে এমন খবর পেয়ে ডিবির একটি দল সেখানে অভিযানে যায়।
তিনি জানান, পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে মাদক ব্যবসায়ীরা গুলি করলে পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। গোলাগুলির এক পর্যায়ে মাদক ব্যবসায়ীরা পিছু হটলে সেখানে বিপ্লবকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। উদ্ধার করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ ঘটনায় আহত পুলিশের দুই সদস্যকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে জানিয়ে ওসি বলেন, ঘটনাস্থল থেকে ২০০ গ্রাম হেরোইন, ২০০টি ইয়াবা, তিনটি গুলির খোসা ও দুটি চাকু উদ্ধার করা হয়েছে।
এদিকে পুলিশের বরাত দিয়ে ছাগলনাইয়া (ফেনী) প্রতিনিধি জানান, গতকাল রবিবার ভোরের দিকে ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার পাঠান নগর ইউনিয়নের পশ্চিম পাঠান গড় গ্রামে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আলমগীর হোসেন ভূঁইয়া (৩৩) নামে এ ব্যক্তি নিহত হয়েছে।
নিহত আলমগীর পাঠান গড় গ্রামের প্রয়াত আব্দুস ছালামের ছেলে। পুলিশ বলছে, আলমগীর ওই এলাকার একজন চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী।
ছাগলনাইয়া থানার ওসি এম মোর্শেদ জানান, উপজেলার পশ্চিম পাঠান গড় এলাকায় মাদকের একটি বড় চালান যাওয়ার খবর পেয়ে রবিবার ভোরে পুলিশের একটি দল সেখানে অভিযানে যায়।
তিনি জানান, পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে মাদক ব্যবসায়ীরা গুলি করলে পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। এক পর্যায়ে গোলাগুলি থামার পর সেখানে আলমগীরকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। উদ্ধার করে ফেনী জেলা সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ ঘটনায় আহত পুলিশের দুই সদস্যকে জেলা সদর হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে জানিয়ে ওসি আরো বলেন, ঘটনাস্থল থেকে একটি বন্দুক, তিন রাউন্ড গুলি, শতাধিক বোতল ফেনসিডিল ও এক হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে।
নিহত আলমগীরের বিরুদ্ধে ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী, ফেনী সদর থানায় ১০টির মতো মামলা রয়েছে বলেও জানান ওসি।
পুলিশের বরাত দিয়ে দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, জেলার বিরল উপজেলায় পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে গাল কাটা বাবু (৪৫) নামে এক মাদকব্যবসায়ী নিহত হয়েছে। এই ঘটনায় দুই পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।
রবিবার ভোরে উপজেলার সরদারপাড়া এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। নিহত গাল কাটা বাবু উপজেলার ২নং ফরাক্কাবাদ ইউনিয়নের তেঘরা নারায়নপুর গ্রামের মৃত ওহাব আলীর ছেলে।
পুলিশ জানায়, বন্দুকযুদ্ধের পর ঘটনাস্থল থেকে দুটি সামুরাই, চারটি ককটেল, দুটি নলা পিস্তল ও ১৯৩ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়েছে। নিহত বাবুর নামে মাদক আইনে ৯টি মামলা আছে।
বিরল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল মজিদ জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে উপজেলার সরদারপাড়া এলাকায় অভিযানে যায় একদল পুলিশ সদস্য। ওই এলাকা দিয়ে সাত/আট জন মাদক ব্যবসায়ী যাওয়ার সময় পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এ সময় মাদক ব্যবসায়ীরা পুলিশের ওপর হামলা চালালে পুলিশও আত্মরক্ষার্থে গুলি চালায়। এতে ঘটনাস্থলেই গালকাটা বাবু নিহত হয়। এই ঘটনায় কনস্টেবল শহীদুল ইসলাম ও আরিফুল ইসলাম আহত হয়েছেন।
পুলিশের বরাত দিয়ে আমাদের যশোর প্রতিনিধি জানান, রবিবার ভোরে যশোরের ছুটিপুর সড়কের রুদ্রপুর গ্রামে কথিত বন্দুকযুদ্ধে এক মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছে। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্র, গুলি ও মাদক উদ্ধার করেছে।
যশোর কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি কে এম আজমল হুদা জানান, যশোরের ছুটিপুর সড়কের রুদ্রপুর গ্রামে দুদল মাদক বিক্রেতা বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে- এমন সংবাদ পেয়ে রবিবার ভোরে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে মাদক ব্যবসায়ীরা পালিয়ে যায়।
তিনি জানান, পরে ঘটনাস্থল থেকে ডালিম (৩৫) নামে এক মাদক ব্যবসায়ীর গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। একই সঙ্গে ঘটনাস্থল থেকে ৫০০ পিস ইয়াবা, একটি ওয়ানশুটার গান, এক রাউন্ড গুলি ও চারটি গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়েছে। পরে পুলিশ মরতেহ উদ্ধার করে যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালের মর্গে পাঠায়।
এর আগে গত শুক্রবার দিবাগত রাতে যশোরের অভয়নগরে র্যাব-৬-এর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় তিন জন মাদক ব্যবসায়ী। তারা হলেন- আবুল কালাম, হাবিব শেখ ও মিলন কাসারী। এর আগে গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে র্যাব-৫-এর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে আবদুল আলীম, একইদিন চট্টগ্রামের বরিশাল কলোনীতে র্যাব-৭-এর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে হাবিবুর রহমান প্রকাশ ওরফে মোটা হাবিব এবং মো. মোশাররফ, ১৭ মে রাজশাহীতে র্যাব-৫ এর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে আবুল হাসান ওরফে হাসান, ১৫ মে নারায়ণগঞ্জে র্যাব-১১-এর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে রিপন এবং একইদিন কুষ্টিয়ায় র্যাব-১২-এর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় হামিদুল ইসলাম নামের আরও এক মাদক ব্যবসায়ী। র্যাব বলছে নিহতরা সবাই শীর্ষ মাদক কারবারি।
অপরদিকে ‘মাদকের আখড়া’ খ্যাত চট্টগ্রাম নগরীর বরিশাল কলোনি থেকে অস্ত্রসহ তিন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গতকাল রবিবার ভোর রাতে ওই কলোনির মালিপাড়া রেলওয়ে ৯ নম্বর কোয়ার্টারের ভেতরের রাস্তা থেকে সদরঘাট থানা পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে। সদরঘাট থানার ওসি নেজাম উদ্দিন এ তথ্য জানিয়েছেন। গ্রেফতার তিন জনের কাছ থেকে ৬২৩ পিস ইয়াবা, একটি বিদেশি পিস্তল, তিনটি কিরিচ ও চার রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয় বলে তিনি জানান।
গ্রেফতার তিন জন হলেন, মো. হানিফ ওরফে খোকন (৩৫), কাজী মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ (২৮) ও খোকন কুমার দাশ (৩২)। তাদের মধ্যে হানিফ ফেনী জেলার সোনাগাজী থানার কুটিরহাট এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রউফের ছেলে। অপর দুই জনের মধ্যে আব্দুল্লাহ সাতকানিয়া উপজেলার বাসিন্দা কাজী গোলাম মাওলার ছেলে এবং খোকন কুমার দাশ পটিয়া উপজেলার বাসিন্দা রঞ্জিত কুমার দাশের ছেলে।
নেজাম উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, রেলওয়ের ৯ নম্বর কলোনিতে কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ী মাদক বিক্রির জন্য একত্রিত হয়েছেন এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে দীর্ঘ দিন ধরে তারা টেকনাফ, কুমিল্লা ও ফেনী থেকে মাদক এনে বরিশাল কলোনিতে বিক্রি করতো।
তিনি আরও বলেন, গ্রেফতারকৃতরা বরিশাল কলোনিতে মাদকের একটা বলয় তৈরি করে মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। বরিশাল কলোনিতে অন্য কোন মাদক সিন্ডিকেট যেন প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য তারা সব সময় নিজেদের সঙ্গে পিস্তল রাখতো। এদিকে মানবাধিকারকর্মী ও পুলিশের সাবেক কর্মকর্তারা বন্দুকযুদ্ধ কোনো সমাধান হতে পারে না বলে মনে করছেন। তাদের মতে, মাদক ব্যবসায়ীরা ভয়ংকর লোক। সে ক্ষেত্রে অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে যদি গোলাগুলিতে কেউ মারা যায়, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে ধরলাম, মেরে দিলাম, এটা কোনো সমাধান হতে পারে না। কারা ব্যবসা করছে, কারা এদের মদদ দিচ্ছে, এর মূল খুঁজে বের করতে হবে। তাদের আইনের আওতায় এনেই নিয়ন্ত্রণের পথ খুঁজতে হবে।