‘আমার তো বয়স হইছে। আমার সঙ্গেই যা যা করছে, তা মুখে বলা যাবে না। আর যেসব মেয়ের বয়স কম, তাদের কথা আর নাই বা বললাম। এ তো এখন সবাই জানে। কিন্তু সবাই জানে বলে, আমরা ফিরে এসেও শান্তিতে নেই। এখন বাংলাদেশও আমাদের জন্য নরক। কারণ আশপাশের অনেকেই জিজ্ঞাসা করে আমার সঙ্গেও সেসব করছে কিনা, সৌদি আরবের মানুষরা। আমি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারি না। শেষ পর্যন্ত বাড়ি ভিটা বিক্রি করে আরেক থানায় গিয়ে বাড়ি করছি।’
এভাবে কথা বলতে বলতে দুচোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছে আরিফার (ছদ্মনাম)। কিছুক্ষণ কাঁদলেন, তারপর ৪০ বছর বয়সের এই নারী বুক চাপড়িয়ে বললেন, ‘ভালো করে লেখেন, যাতে আর কোনো মেয়ে সৌদি আরব বা আরবের কোনো দেশে না যায়। তারা মানুষ না, তারা পশু। দেশে না খেয়ে মরা ভালো। এত মারধর, খাবার কষ্ট আর যৌন নির্যাতন সহ্য করা যায় না।’
বিদেশ ফেরত ২২ নারীকে সোমবার আর্থিক সহায়তা দেয় ব্র্যাক ও লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফেকচারারস অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন। তাদের এক লাখ টাকা করে এককালীন অনুদান দেওয়া হয়। ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আরও ৫০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে চাকরির নিশ্চয়তা সংক্রান্ত এক সমঝোতা স্মারক সই করে এই দুই প্রতিষ্ঠান। সেখানে উপস্থিত কয়েকজন নারীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
আরিফা যৌন নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে বলেন, অনেক বাসায় বাংলাদেশি মেয়েদের বাবা-ছেলে এবং তাদের আত্মীয়রা যৌন নির্যাতন করে। কি যে কষ্ট তা বলে বোঝানো যাবে না। তারা সব সময় বলে আমাদের দুই লাখ টাকা দিয়ে কিনেছে, তাই যা খুশি করতে পারবে। তবে সবচেয়ে কষ্ট বেশি খাবারের। খবারের কষ্ট তো সহ্য করা যায় না।
জর্ডান ফেরত সুমি বেগম (ছদ্মনাম) দিলেন আরেক রোমহর্ষক তথ্য। ২৩ বছরের এই নারী বলেন, তিনি জর্ডানে যাওয়ার পরে যে বাড়িতে কাজে যোগ দিয়েছিলেন, সে বাড়ি থেকে তাকে বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দিতো না। মারধর আর খাবারের কষ্ট তো আছেই। এক পর্যায়ে তিনি ওই বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। তারপর পরিচয় হয় সোনিয়া নামের এক বাংলাদেশি মহিলার সঙ্গে। তিনি আছিয়াকে বাসায় নিয়ে যান।
কিন্তু সেখানে সুমি দেখেন আরেক নরক। সেটা হলো একটা মিনি পতিতালয়। অনেক মেয়েকে সেখানে আটকে রাখা হয়েছে। তাদের দিয়ে দেহ ব্যবসা করানো হয়। কেউ করতে না চাইলে এখানেও চলে মারধর আর খাবারের কষ্ট। বাইরে থেকে তালা দেওয়া থাকে, তাই কেউ বাইরে যেতে পারে না। বাংলাদেশি বলে যাকে বিশ্বাস করেছিল সেই তাকে পতিতালয়ে রেখেছে। কথাগুলো বলতে বলতে সুমিরও চোখ দিয়ে পানি ঝরছিল অঝোরে।
সুমি আর কথা বাড়াতে পারলেন না। শুধু বললেন, সেই মহিলাই তাকে একদিন পুলিশের কাছে তুলে দিয়েছে দেহ ব্যবসা করার অপরাধে। কারণ তিনি ওই মহিলার সঙ্গে অনেক দিন খারাপ ব্যবহার করেছেন। দুই মাস জেল খাটার পর দেশে ফিরেছেন সুমি। চোখ মুছতে মুছতে মায়ের হাত ধরে ব্র্যাক সেন্টার থেকে বাড়ি গেলেন সুমি। সামনে অন্ধকার জীবন। বিয়ে করতে গেলেও সমস্যা আর সমাজও তাকে ভালো চোখে দেখবে না।
হাসিনা বেগম বললেন আরেক কষ্টের ঘটনা। ‘মাসের পর মাস নির্যাতন আর খাবারের কষ্ট সহ্য করে চাকরি করলেও বেতন পেতেন না। দুই-তিন মাস পরপর বেতন দিতো। বেতন চাইলে মারধর করা হতো। হাসিনা বেগম বলেন, একদিন বেতনের কথা বলছি আমার বুকে পা দিয়ে লাথি মারা হয়েছে। আমি অসুস্থ হয়ে যাই আমার কোনো চিকিৎসা করে না। সেই বাসার বাংলাদেশি ড্রাইভারের সাহায্য নিয়ে একদিন পালিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে এসেছি। আল্লাহর কাছে অনেক শুকরিয়া যে বেঁচে আছি। আমি শুনেছি অনেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছেন।’
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, ‘মাদকের সঙ্গে সঙ্গে মানব পাচার আমাদের সমাজকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আমাদের দেশের মেগা প্রোজেক্ট পদ্মা ব্রিজ কাদের টাকায় হচ্ছে? আমাদের এই শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সের টাকায়। আমরা বছরে ১৪-১৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাই। এতগুলো মানুষ ফিরে আসে কত টাকা সঙ্গে নিয়ে? যেই টাকা পায়, সেই টাকায় চাকরি তো আমরা এখানেই দিতে পারি। এসব বিষয় সরকারকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। শুধু নারীদের না পুরুষ শ্রমিকদেরও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে পাঠাতে হবে।’
লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফেকচারারস অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরবে নারীদের পাঠানোর চেয়ে দেশেই তাদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করা সম্ভব। আমাদের সুযোগ আছে, আমরা সম্মানের সঙ্গে তাদের চাকরিতে নেবো। আমাদের দেশের নারীরা গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরবে যাবে না। আমরা তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে চাকরি দেবো।
সাইফুল ইসলাম বলেন, পত্রপত্রিকায় এই নারীদের দুঃখগাথা পড়ে একটা প্রশ্নই মাথায় আসে। তা হলো মানুষ কীভাবে এত দানব হতে পারে? এই দুঃখ করে এখন কি হবে? এখন আর শোক করে লাভ নেই, কিছু একটা করতে হবে। আমাদের দেশে পাঁচ কোটির মতো শ্রমিক রয়েছে। এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ সবার সঙ্গে আমার যোগাযোগ রয়েছে। আমি তাদেরকেও আহ্বান জানাবো। আমাদের অনুরোধ গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরবে নারীদের পাঠাবেন না।’
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের হেড শরিফুল হাসান বলেন, ‘এয়ারপোর্টে মধ্যরাতে ফিরে আসে আমাদের এই মেয়েরা। তাদের যাওয়ার কোনো জায়গা থাকে না। দুঃসহ অবস্থার এমন বর্ণনা তারা দেয় যে, আপনারা রাতে ঘুমাতে পারবেন না। আমি আমার বাসার মেয়েটাকে সৌদি আরব পাঠাবো না, তাহলে এদেরকে কেন পাঠাচ্ছি? আমাদের মন্ত্রী সচিবরা কেন সৌদি আরবের সুরে কথা বলেন? কিছু করতে না পারুক অন্তত এই মেয়েগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে বলতে তো পারেন ‘আমরা দুঃখিত’।