চোখ এখন গাজীপুরে

আগামী ২৬ জুন গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন। রাজধানী ঢাকার কাছে হওয়ায় গাজীপুর নির্বাচন নিয়ে সচেতন সবার মধ্যেই আগ্রহ এবং কৌত‚হল রয়েছে। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনও এখন অতিরাজনৈতিক গুরুত্ব পাচ্ছে। আমাদের দেশে নির্বাচনে ভোটাররা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রার্থীর চেয়ে প্রতীককে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে প্রতীকের চেয়ে প্রার্থীর যোগ্যতা, গুণাগুণ অধিক বিবেচনায় নেয়া হতো। এখন আগে দল, রাজনীতি, তারপর প্রার্থী! গাজীপুরেও নৌকা এবং ধানের শীষের মধ্যেই লড়াই হবে। নৌকা আওয়ামী লীগের প্রতীক এবং বিএনপির প্রতীক ধানের শীষ। নৌকা প্রতীক নিয়ে লড়ছেন জাহাঙ্গীর আলম আর ধানের শীষের প্রার্থী হাসানউদ্দিন সরকার। নির্বাচনে আরো প্রার্থী এবং প্রতীক থাকলেও শেষ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা যে সীমাবদ্ধ থাকবে নৌকা-ধানের শীষের মধ্যে সেটা জোর দিয়েই বলা যায়।

কি হবে গাজীপুর সিটির নির্বাচনী ফল? গাজীপুরবাসী কাকে বেছে নেবেন পাঁচ বছরের জন্য তাদের নগর পিতা হিসেবে? আওয়ামী লীগ আশা করছে তাদের প্রার্থীই হবেন গাজীপুরের পরবর্তী মেয়র। নগরবাসী তাদের নগরের উন্নয়নের স্বার্থেই সরকার দলীয় প্রার্থীকে ভোট দেবেন। গত ১৫ মে অনুষ্ঠিত খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মানুষ যেমন উন্নয়নের পক্ষে ভোট দিয়েছেন, গাজীপুরেও তাই দেবেন। মানুষ ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে এখন আর ভুল করেন না। বিএনপি প্রার্থীকে ভোট দিলে এলাকার উন্নয়ন যে বাধাগ্রস্ত হয়, ভোটারদের সে অভিজ্ঞতা হয়েছে।

গাজীপুরে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা ভালো। বলা হয়ে থাকে, গোপালগঞ্জের পর আওয়ামী লীগের শক্তিশালী দুর্গ হলো গাজীপুর। অবশ্য গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিপুল ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন। তবে গত নির্বাচনের পরিস্থিতি এখন নেই বলে মনে করা হচ্ছে। গত নির্বাচনে ‘হেফাজত ফ্যাক্টর’ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে কাজ করেছিল। শাপলা চত্বরে হেফাজতকে মোকাবেলার সরকারি পদ্ধতি অনেকের পছন্দ হয়নি। সেখানে মৃতের সংখ্যা নিয়ে পরিকল্পিতভাবে নানা গুজব ছড়িয়ে মানুষের মন বিষিয়ে দেয়া হয়েছিল। সরকার এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সে সময় নেতিবাচক প্রচারণা ছিল তুঙ্গে। তাছাড়া আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধ-কোন্দলও মেটানো যায়নি। দলীয় প্রার্থীর পক্ষে দল একাট্টা হয়ে নামেনি। বিজয় ছিনিয়ে আনার জন্য মাটি কামড়ে থাকার চেষ্টা আওয়ামী লীগের ছিল না। তাছাড়া বিরোধী প্রার্থীকে ভোট দিয়ে সরকারকে একটি সতর্কবার্তা দেয়ার ইচ্ছাও হয়তো অনেকের মধ্যে ছিল। সব মিলিয়ে সরকার এবং আওয়ামী লীগের জন্য হাওয়া ছিল কার্যত প্রতিকূলে।

গত পাঁচ বছরে পরিস্থিতি বদলেছে। বিএনপির সক্ষমতা মানুষ পরিমাপ করতে পেরেছে। সরকার যেটা করতে চায়, সেটা করতে পারে। বিএনপি যা বলে তা করার সাধ্য তাদের নেই। সরকারি দলের প্রার্থীকে ভোট না দিলে কি হয় সেটাও মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। এক বা একাধিক সিটি করপোরেশনে জয়লাভ করে বিএনপি সরকারের জন্য বড় কোনো চ্যালেঞ্জ হতে পারে না। উল্টো সরকারের অসহযোগিতায় স্থানীয় উন্নয়ন কাজ ব্যাহত হয়। জনজীবনে সংকট বৃদ্ধি পায়। বিএনপি পরিস্থিতি মোকাবেলায় সক্ষমতা ও দক্ষতা দেখাতে পারে না। এবার গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপিকে তাদের আগের মেয়রের ব্যর্থতার দায় বহন করতে হবে। বিএনপি যদিও মনে করছে যে, এবারো মানুষ ধানের শীষেই ভোট দেবে। কারণ সরকারি দলের ওপর নানা কারণে মানুষের বিরক্তি চরমে। মানুষ ভোট দেয়ার সুযোগ পেলেই সরকারের প্রতি তাদের অনাস্থার মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটাবে।

খুলনায় অবশ্য বিএনপির এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। মানুষ জেনেশুনে কেন এমন একটি দলকে ভোট দেবে যে দলটি বড় ধরনের রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক সংকটের মধ্যে সময় অতিক্রম করছে? বিএনপি নানা উপায়ে মানুষের সহানুভ‚তি পাওয়ার চেষ্টা করছে। দলীয় প্রধান খালেদা জিয়ার জেল, তার গুরুতর অসুস্থতা ইত্যাদি বলে মানুষকে বিএনপির প্রতি দুর্বল করার যে চেষ্টা বিএনপি করছে, এখন পর্যন্ত তার কোনো ইতিবাচক ফল কোথাও দেখা করা যাচ্ছে না। উল্টো খালেদা জিয়ার জেল, জেলে তার অসুস্থতা, লন্ডনপ্রবাসী তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব প্রদান- এগুলো বিএনপির ভবিষ্যৎ নিয়েই মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। অতি সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের যে দৌড়ঝাঁপ বিএনপি শুরু করেছে, তাও বিএনপির রাজনীতিতে সুফল বয়ে আনবে কি না সেটা নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট মন্তব্য করার সময় এখনো হয়নি। তবে বিএনপির ভারতপ্রীতির কথা নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রচারণায় আনবে।

এতদিন যে অস্ত্র দিয়ে আওয়ামী লীগকে ঘায়েল করতে চেয়েছে বিএনপি এখন সেই অস্ত্র বিএনপির বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক নিয়ে বিএনপি এতদিন যে জঘন্য রাজনীতি করেছে, এখন বিএনপিকে তার খেসারত দিতে হবে। গাজীপুর নির্বাচন থেকে বিএনপিকে ভারতের প্রতি নতজানু হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে। গাজীপুরে বা অন্য কোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জয়-পরাজয় যেটাই হোক না কেন তাতে বিএনপির কোনো সমস্যা নেই। জিতলে ভালো। বলতে পারবে, জনগণ তাদের পক্ষে। সরকারের পায়ের নিচে মাটি নেই। আবার হারলে বলবে, তাদের বিজয় ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। ভোট সুষ্ঠু হয়নি। এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয় সেটা আবার প্রমাণ হলো।

বিএনপি আগেই বলে রেখেছে, গাজীপুর নির্বাচনের ফলাফল দেখে তারা পরের নির্বাচনগুলোতে অংশ নেয়া না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেবে। গাজীপুর নির্বাচনে তাদের হারিয়ে দেয়া হলে তারা তা মানবে না। বিএনপি মনে করে, খুলনাতেও তাদের হারানো হয়েছে। কারচুপি না হলে, সুষ্ঠু ভোট হলে, সবাই ভোট দিতে পারলে বিএনপি প্রার্থীর বিজয় ঠেকানো সম্ভব হতো না। গাজীপুরে যদি খুলনার পুনরাবৃত্তি ঘটে তাহলে বিএনপি এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশ নাও নিতে পারে। তবে এসব হুমকি আসলে সরকারকে চাপে রাখার কৌশল কি না সে প্রশ্নও রয়েছে।

নির্বাচন থেকে বিরত থাকলে বড় ক্ষতি হবে বিএনপিরই। কোনো অজুহাতেই কোনো নির্বাচন থেকে দূরে থাকা বিএনপির জন্য হবে আত্মঘাতী। সরকার বা আওয়ামী লীগও জয়ের জন্যই নির্বাচন করছে। এ লক্ষে তাদের সুনির্দিষ্ট ছক বা পরিকল্পনা আছে। বছর শেষে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার গাজীপুরেও নৌকার জয় চাইবে। খুলনার পুনরাবৃত্তিই গাজীপুরে ঘটবে বলে তারা আশা করছে।

খুলনার জয়ের পর স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগে চাঙ্গা ভাব এসেছে। খুলনায় যে কৌশলে তারা সফল হয়েছে, গাজীপুরেও সেই কৌশল প্রয়োগ করা হবে বলে ধারণা করা যায়। খুলনায় প্রার্থীর পক্ষে পুরো দল ঐক্যবদ্ধ ছিল। প্রার্থীর যোগ্যতা নিয়েও কোনো প্রশ্ন ছিল না। গাজীপুরেও দল যাতে জাহাঙ্গীর আলমের পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামে তার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গাজীপুরে আওয়ামী লীগ যেমন জনপ্রিয়, তেমনি সেখানে দলের মধ্যে অনৈক্য-রেষারেষিও বেশি। অনেকেই নির্বাচনী লড়াইয়ে নিজেদের যোগ্য মনে করেন। জাহাঙ্গীর আলমকে মনোনয়ন দেয়ায় সবাই খুশি হননি। তবে এই নাখোশ নেতাদের হাই কমান্ড থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, কারো অসহযোগিতার জন্য জাহাঙ্গীর আলম পরাজিত হলে ভবিষ্যতের নির্বাচনে তাকে আর দল থেকে মনোনয়ন দেয়া হবে না। দলীয় প্রার্থীর পক্ষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে কেন্দ্র থেকে কড়া নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

গাজীপুর সিটি নির্বাচন একদিকে যেমন বড় দুই দলের জন্য প্রেস্টিজ ইস্যু, তেমনি এই নির্বাচন হবে নবীন-প্রবীণের লড়াইও। বিএনপি প্রার্থী হাসানউদ্দিন সরকার বয়সে প্রবীণ। তিনি অভিজ্ঞ। আগে জাতীয় পার্টি করতেন। গাজীপুরের রাজনীতিতে তিনি পরিচিত মুখ। আওয়ামী লীগ প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম বয়সে নবীন, তরুণদের মধ্যে তার বিশেষ প্রভাব আছে। গত নির্বাচনের পর থেকেই তিনি মাঠে আছেন। সব মহলেই তার যোগাযোগ আছে। পরিচিতিও কম নয়। দল ঐক্যবদ্ধ থাকলে ফলাফল অনুক‚লে আনতে তেমন বেগ পেতে হবে না বলেই অনেকে মনে করেন। গাজীপুরেও লড়াই হবে সমানে সমান।




গাজীপুরের দিকে এখন রাজনীতি আগ্রহী সবারই চোখ। এই সিটি নির্বাচনের ফলাফল জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। নির্বাচন কমিশনের জন্যও গাজীপুর নির্বাচন কম বড় পরীক্ষা নয়। নির্বাচন যদি শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন না হয়, মানুষ যদি পছন্দের প্রার্থীকে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে না পারে তাহলে মানুষ হয়তো পরিস্থিতির কারণে ফলাফল মেনে নেবে এবং মনে অস্বস্তি থাকবে। বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকলে এক সময় চাপা ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়। নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ সব দিক বিবেচনায় নিয়েই গাজীপুরে তাদের নিজ নিজ কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করবেন- এটাই আমাদের প্রত্যাশা। গাজীপুরের নির্বাচনই দেশের শেষ নির্বাচন নয়। তাই অতিরিক্ত চাপ নিয়ে পরিস্থিতি জটিল ও অস্বাভাবিক করে তোলার কোনো মানে হয় না।

বিভুরঞ্জন সরকার : কলাম লেখক।




নাম

অর্থ ও বাণিজ্য,235,আন্তর্জাতিক,731,কাপাসিয়া,342,কালিয়াকৈর,417,কালীগঞ্জ,253,খেলা,644,গাজীপুর,3936,চাকরির খবর,33,জয়দেবপুর,1581,জাতীয়,2957,টঙ্গী,911,তথ্যপ্রযুক্তি,512,ধর্ম,196,পরিবেশ,136,প্রতিবেদন,310,বিজ্ঞান,55,বিনোদন,697,ভিডিও,58,ভিন্ন খবর,142,ভ্রমন,115,মুক্তমত,27,রাজধানী,829,রাজনীতি,1055,লাইফস্টাইল,283,শিক্ষাঙ্গন,398,শীর্ষ খবর,10756,শ্রীপুর,481,সাক্ষাৎকার,12,সারাদেশ,649,স্বাস্থ্য,212,
ltr
item
GazipurOnline.com: চোখ এখন গাজীপুরে
চোখ এখন গাজীপুরে
https://1.bp.blogspot.com/-22lPTL6omqc/Wyjn3pVpkkI/AAAAAAAAYzs/f_PEA4-XMLAHdMMLkP4ymKNjh6YUE1uhQCLcBGAs/s400/bivuranjan1.jpg
https://1.bp.blogspot.com/-22lPTL6omqc/Wyjn3pVpkkI/AAAAAAAAYzs/f_PEA4-XMLAHdMMLkP4ymKNjh6YUE1uhQCLcBGAs/s72-c/bivuranjan1.jpg
GazipurOnline.com
https://www.gazipuronline.com/2018/06/bivu.html
https://www.gazipuronline.com/
https://www.gazipuronline.com/
https://www.gazipuronline.com/2018/06/bivu.html
true
13958681640745950
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Read More Reply Cancel reply Delete By প্রচ্ছদ PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share. STEP 2: Click the link you shared to unlock Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy