সিটি নির্বাচন ঘিরে গাজীপুরে এখন উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়েছে। শেষ মুহূর্তে প্রার্থী, কর্মী-সমর্থকদের প্রচারণায় উত্তাল হয়ে উঠেছে এই শিল্প নগরী। শুক্রবার ছুটির দিনে প্রচার-প্রচারণায় মুখরিত ছিল নগরীর প্রতিটি অলিগলি। প্রধান দুই দলের স্থানীয় নেতাদের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় নেতারাও চষে বেড়াচ্ছেন গাজীপুরে। শুক্রবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা গাজীপুরে এক মসজিদে জুমার নামাজও পড়েছেন। প্রধান দুই দলের মেয়র প্রার্থীরাও শেষ সময়ে ভোট প্রার্থনা করছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। নির্বাচনী আচরণবিধি অনুয়ায়ী আজকের পর থেকে বহিরাগতদের এলাকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ। রবিবার মধ্যরাত থেকে আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শেষ।
গাজীপুর সিটি নির্বাচনের শুক্রবার আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট মো. জাহাঙ্গীর আলম ১৩নং ওয়ার্ড কলাবাগান থেকে প্রচারণা শুরু করেন। এরপর মজলিসপুর, খলাপাড়া, বাংলাবাজারে গণসংযোগ ও পথসভা করেন। জাহাঙ্গীর আলম চান্দনা চৌরাস্তা জামে মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করেন। বিকেল ৩টা থেকে পুনরায় ১৯নং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রচারণা শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে শুক্রবার ১৬, ১৮, ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে গণসংযোগ ও পথসভা করেন। অপরদিকে বিএনপি প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার জগিতলা, চান্দনা, মুগলখাল ১৭নং ওয়ার্ডের এই তিনটি এলাকায় প্রচারণা চালান। বাইতুল ইসলাম জামে মসজিদে হাসান সরকার জুমার নামাজ আদায় করেন। বিকালে তিনি বাসাইল এলাকায় প্রচারণাা চালিয়েছেন।
আওয়ামী লীগ-বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের একই মসজিদে জুমা: গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রচারে গিয়ে একই মসজিদে নামাজ পড়লের পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বি দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা।
ভোটের ময়দানে একে অপরের সমালোচনাকারী দুই পক্ষের একই কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায়ের বিষয়টি ওই এলাকায় আলোচনার খোরাক তৈরি করেছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার সকালে দুই দলের স্থানীয় নেতাদের পাশাপাশি ঢাকা থেকে যান কেন্দ্রীয় নেতারা।
দুপুরে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুর রহমান মিলন এবং তাদের সহযোগীরা ছিলেন গাজীপুর শহরে। জুমার নামাজ পড়তে নেতাদের সবাই গাজীপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে ঢোকেন। আর নেতাদের দেখে চমৎকৃত হন মুসল্লিরা। নামাজ শেষে মুসল্লিদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন দুই দলের নেতারা। সেখানে মুসল্লিরা তাদের সঙ্গে ছবিও তোলেন।
আওয়ামী লীগ নেতা মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, ‘এই সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ প্রমাণ করে বর্তমান সরকার একটি নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক পরিবেশে নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। গাজীপুরে একটি চমৎকার এবং উৎসবমুখর পরিবেশ বজায় রয়েছে।’
শেষপর্যন্ত মাঠে থাকার ঘোষণা বিএনপি প্রার্থীর: গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার বলেছেন, সব বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও ভোটের দিন পর্যন্ত মাঠে থাকব। শুক্রবার নগরীতে প্রচারণা চালানের সময় তিনি অভিযোগ করেন, ‘সরকার ও প্রশাসন থেকে বিএনপির নেতাকর্মীদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। নির্বাচনে পক্ষপাতিত্ব করতেই এসব করা হচ্ছে।’
হাসান উদ্দিন সরকার আরও বলেন, ‘এই নির্বাচন শুধুমাত্র চেয়ারে বসার জন্য নয়। একজন সাবেক নারী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বর্তমান সরকার অমানবিক যে আচরণ করছে, তার প্রতিবাদ করতেই নির্বাচনে দাঁড়িয়েছি।’
শুক্রবার সকালে সিটি করপোরেশনে অন্তর্ভুক্ত সাবেক বাসন ইউনিয়নের মুগরখাল এলাকায় প্রচারণা শুরু করেন বিএনপির এই মেয়র প্রার্থী। পরে তিনি চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় প্রচারণা চালান। এ সময় হাসান উদ্দিন সরকার দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার স্বার্থে ধানের শীষে সবার ভোট প্রার্থনা করেন।
এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন দলীয় মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের পক্ষে প্রচারণা চালাতে গাজীপুর নগরীর বিভিন্ন সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। এর আগে সকালে তিনি হাসান উদ্দিন সরকারের বাসভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তিনি বলেন, জনগণ ভোট দিতে পারলে বিশাল ভোটের ব্যবধানে আমাদের প্রার্থী বিজয়ী হবে। তাই আমরা মাঠে আছি, মাঠে থাকবো। কোনো অজুহাতে যেন আর গ্রেফতার না হয় সরকারকে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। নির্বাচনের দিন পর্যন্ত আমরা পর্যবেক্ষণ করবো। তারপর অবস্থা বুঝে আমরা পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবো।
তিনি আরও বলেন, সরকার যে হীন ষড়যন্ত্র ও কৌশল করছে আমরা তাদের এই বলে সাবধান করতে চাই, জনগণ কিন্তু তাদের এ ধরনের অপকৌশল বুঝে। তাই তারা বিরত হবেন। আর কোনো গ্রেফতার যেন না হয়, যাতে করে জনগণ নিজের হাতে ভোট দিতে পারেন এই ব্যবস্থা করবেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন, গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি ও ধানের শীষ প্রতীকের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক ফজলুল হক মিলন, সিনিয়র সহসভাপতি সালাহ উদ্দিন সরকার, জেলা ছাত্রদলের সভাপতি সরাফত হোসেন প্রমুখ নেতারা। তিনি সর্বশেষ বিকেল সাড়ে ৪টায় পূবাইল মিরের বাজারে পথসভা করেন।
ক্লিন সিটি উপহার দিতে নৌকায় ভোট চাইলেন জাহাঙ্গীর: আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়রপ্রার্থী মো. জাহাঙ্গীর আলম শুক্রবার প্রচারণা চলাতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমাকে ভোট দেন, নৌকাকে ভোট দেন। আমি ক্লিন এবং গ্রিন সিটি উপহার দিতে চাই। সবাইকে একটি বাসযোগ্য শহর দিতে চাই।’ গতকাল শুক্রবার চান্দনা চৌরাস্তা জামে মসজিদে জুমার নামাজ শেষে মসজিদ আঙিনায় মুসল্লিদের উদ্দেশে এসব কথা বলেন।
জাহাঙ্গীর আলম অভিযোগ করে বলেন, ‘বিএনপি মিথ্যাচার করে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। বর্তমান সরকারের যে ধারাবাহিক উন্নয়ন তা বাধাগ্রস্ত করতেই বিএনপি নেতারা পরিকল্পিতভাবে ভোটারদের বিভ্রান্ত করছেন। তাই সেসব কথায় কান না দিয়ে বর্তমান সরকারের সুন্দর দেশ গড়ার যে গতি তা আরও গতিশীল করতে নৌকা মার্কায় ভোট দিতে আহ্বান জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘এখানকার সমাজ ব্যবস্থায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রয়োজন আছে। আমি সবার জন্য কাজ করতে চাই। আলেম-ওলামা, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যায়ের শিক্ষক, চাকরিজীবী, শ্রমিক, সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষ, শ্রমিক, কৃষক, নারী, যুবক, শিশু সবার উপযোগী একটি প্যাকেজ তৈরি করেছি। আমাকে ভোট দেন। আমি আপনাদের সঙ্গে নিয়ে একটি পরিকল্পিত শহর গড়ে তুলবো।’
৩৩৭টি কেন্দ্রই ঝুঁকিপূর্ণ: গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ৪২৫টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৩৩৭টি কেন্দ্রকেই ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সেই হিসাবে গাজীপুর সিটিতে গড়ে ৭৯ দশমিক ২৫ শতাংশ ভোটকেন্দ্র ঝুঁকিতে আছে। আর বাকি ৮৮টি ভোটকেন্দ্রকে ঝুঁকিমুক্ত হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে অতিরিক্ত পুলিশ ও আনসারের সদস্য মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম ও বিএনপির প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের নিজ নিজ ওয়ার্ডের সবগুলো কেন্দ্রকেই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে প্রশাসন। গাজীপুর পুলিশ (এসপি) সুপারের কার্যালয় থেকে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। ওই তালিকা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়েছে। এসব কেন্দ্রের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে কর্তৃপক্ষ। বিএনপির পাশাপাশি ভোটারদের মধ্য থেকেও গাজীপুর সিটি নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের দাবি ওঠে। তবে বুধবার গাজীপুরে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক সভায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি নাকচ করে দিয়েছেন।