সবুজ ছায়াঘেরা বাড়িটির দিকে ছিল জনস্রোত। কাকডাকা ভোর থেকে দিনভর ছিল মানবঢল। শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, অবালবৃদ্ধবণিতার পদভারে বুধবার মুখর ছিল ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণ।
ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ৬৭৭ নম্বর সাদা রঙের তিনতলা বাড়িটি যেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পিঠস্থান। বাড়ির সম্মুখভাগে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল। যাতে লেখা ‘যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান/ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান’। পদ্মা যমুনার স্রোতের মতোই সেখানে পুষ্পার্ঘ্য দিতে সকাল থেকে নামে শোকার্ত মানুষের ঢল। হাতে কালো ব্যানার, বুকে কালো ব্যাজ পরিহিত হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিল ঐতিহাসিক সেই বাড়িটির সামনে।
বাঙালির শোকের দিন জাতীয় শোক দিবসে রাজধানীর সব পথই যেন মিশে গেল স্বাধীনতার সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত ধনামন্ডির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক ওই বাড়িটিতে। শোকের দিনে শ্রদ্ধার অর্ঘ্য নিবেদন করেছেন ধানমন্ডি লেকপাড়ে স্থাপিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্থায়ী প্রতিকৃতিতে। অংশ নিয়েছেন শোক দিবসের নানা আয়োজনে।
জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দল ও সংগঠনের নেতাকর্মীরা সেখানে জড়ো হন ভোর থেকেই। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সব বয়সের মানুষ সারিবদ্ধভাবে দীর্ঘ অপেক্ষায় ছিলেন জাতির জনকের প্রতি প্রাণের অর্ঘ্য নিবেদনে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শোকার্ত মানুষের ভিড় যেন বেড়েই চলছিল। এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু ভবন চত্বর, ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়ক এবং রাসেল স্কয়ার এলাকা পরিণত হয় জনারণ্যে।
মাঝখানের কিছুটা সময়ের কঠোর নিরাপত্তা বলয় অবশ্য জনতার স্বতঃস্ফূর্ততায় কিছুটা হলেও বিঘœ সৃষ্টি করে। এ নিরাপত্তার উপলক্ষ ছিল রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন কর্মসূচিকে ঘিরে। এ সময় রাসেল স্কোয়ার থেকে শুরু করে ৩২ নম্বর সড়কে নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়। সড়কের দু’দিকের প্রবেশমুখে আর্চওয়ে গেট আর মেটাল ডিটেক্টরের কড়া তল্লাশির মাধ্যমে প্রবেশের অনুমতি মিলেছে অভ্যাগতদেরও।
রাজধানীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি, বনানী কবরস্থানে ১৫ আগস্টে অন্য শহীদদের কবর এবং গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধে গতকাল দিনভর শ্রদ্ধা জানায় সমাজের সর্বস্তরের জনতা। বেদনাসিক্ত হৃদয়ে কালো ব্যাজ ধারণ করে তারা স্মরণ করেন এ দেশের অভ্যুদয়ের মহানায়কের ৪৩তম শাহাদাতবার্ষিকী।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর একদল কর্মকর্তা ও সৈনিকের হাতে সপরিবারে জীবন দিতে হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে। তার পরিবারের ছয় বছরের শিশু থেকে শুরু করে অন্তঃসত্ত্বা নারীও সেদিন ঘাতকের গুলি থেকে রেহাই পায়নি। জাতীয় এই শোকের দিনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়, পালিত হয়েছে নানা কর্মসূচি।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা
রাষ্ট্রপ্রধান মো. আবদুল হামিদ ও সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বুধবার সকালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর প্রাঙ্গণে জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। ফুল দিয়ে সেখানে কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন তারা। তিন বাহিনীর একটি চৌকস দল এ সময় সশস্ত্র সালাম জানায়; বিউগলে বেজে ওঠে করুণ সুর। এরপর কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে ১৫ আগস্ট নিহতদের আত্মার শান্তি কামনায় বিশেষ মোনাজাত করা হয়।
ফুল দিয়ে রাষ্ট্রপতি বঙ্গভবনের উদ্দেশ্যে রওনার হওয়ার পর স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দেন। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানান নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ।
আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসাবে শেখ হাসিনা দলের সভাপতিমণ্ডলী, সম্পাদকমণ্ডলী, কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য এবং উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের নিয়ে জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে ফুল দেন।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী চলে যাওয়ার পর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সবার শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য খুলে দেওয়া হয়। বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি হাজারো মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ককের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানান।
৪৩ বছর আগে সেই রাতে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু ছাড়াও স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, শেখ জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসেরকে হত্যা করে।
সেই রাতেই নিহত হন বঙ্গবন্ধুর বোনের স্বামী আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ, মেয়ে বেবী ও শিশুপৌত্র সুকান্ত বাবু; বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, নিকট আত্মীয় শহীদ সেরনিয়াবাত ও রিন্টু।
ধানমন্ডির বাড়িতে পুলিশের বিশেষ শাখার সাব ইন্সপেক্টর সিদ্দিকুর রহমান ও নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিলকেও গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় সে সময় প্রাণে বেঁচে যান।
বঙ্গবন্ধুকে জন্মস্থান গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় দাফন করা হলেও পরিবারের অন্য সদস্যদের ঢাকার বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়। বনানী কবরস্থানে তাদের কবরে সকালে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা। পরে সেখানে মোনাজাত ও মিলাদ মাহফিল হয়। প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সকালে টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতেও শ্রদ্ধা জানান।
দিনটি উপলক্ষে দেশের সব ধর্মীয় উপসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দুস্থদের মধ্যে খাবার বিতরণ করা হয়। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে দুপুরে বঙ্গভবনের দোয়া মাহফিলে রাষ্ট্রপতি উপস্থিত ছিলেন।
রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা কর্মসূচি পালন করছে এ দিনে। শোক দিবস উপলক্ষে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ, পোস্টার বিতরণ এবং বঙ্গবন্ধুর উপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার এবং বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো প্রচার করেছে বিশেষ অনুষ্ঠান।
সকালে রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির ও তেজগাঁও চার্চে ১৫ আগস্ট নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করে বিশেষ প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে রাজধানীর কারওয়ান বাজার পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে আলোচনা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন।
শোক দিবস উপলক্ষে দিনব্যাপী কোরআন তেলাওয়াত, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, কালো ব্যাজ ধারণ, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, মিলাদ মাহফিল, রক্তদান কর্মসূচি, আলোচনা সভা, আলোকচিত্র প্রদর্শনী ও দুস্থদের মাঝে খাবার বিতরণ করা হয়।
রাজধানী ছাড়াও সারাদেশে এবং দেশের বাইরে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনগুলো বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদনসহ নানা কর্মসূচির মধ্যদিয়ে দিবসটি পালন করছে। এদিকে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে সারা দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে দরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়।
বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির মিলাদ
রাষ্ট্রপতি এম আব্দুল হামিদ জাতীয় শোক দিবস ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৩তম শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে বাদ জোহর বঙ্গভবনে দরবার হলে দোয়া ও মিলাদের আয়োজন করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল ঘাতকের বুলেটে নির্মমভাবে নিহত বঙ্গবন্ধু তার পরিবারের সদস্য ও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগকারী শহীদ এবং বিভিন্ন সময় গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়।
মিলাদ ও দোয়া মাহফিলে রাষ্ট্রপতির পরিবারের সদস্য, সংশ্লিষ্ট সচিবগণ, বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তা এবং বঙ্গভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মিলাদ ও দোয়া মাহফিলে যোগ দেন।
বঙ্গভবন জামে মসজিদের পেশ ইমাম মওলানা মুহাম্মদ সাইফুল কবির মোনাজাত পরিচালনা করেন। এর আগে বঙ্গভবনে দরবার হলে চলচ্চিত্র প্রকাশনা অধিদফতরের পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের ওপর একটি প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শন করা হয়।
শাহাদত বার্ষিকীর মিলাদে প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাদ আছর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৩তম শাহাদত বার্ষিকী উপলক্ষে রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২-এ বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত মিলাদ ও দোয়া মাহফিলে অংশ গ্রহণ করেন।
বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা, প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, জামাতা খন্দকার মাশরুর হোসেন, শেখ রেহানার পুত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি এবং প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যগণ ও আত্মীয়-স্বজনরা মাহফিলে যোগ দেন। এ ছাড়া কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী এবং বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগ ও যুব মহিলা লীগের নেতা-কর্মীরা দোয়া মাহফিলে অংশগ্রহণ করেন। মাহফিলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ও ১৫ আগস্টের অন্য শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। এ ছাড়া ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহতদের রুহের মাগফেরাত কামনা করেও মোনাজাত করা হয়।