ভাওয়াল রাজা: মৃত্যুর বারো বছর পর ফিরে এসেছিলেন যে

রমেন্দ্রনারায়ণ ফিরে এসেছেন! বারোটা বছর কেটে গেছে, সবাই জানতো তিনি মারা গিয়েছেন। সরকারী ডাক্তার সার্টিফিকেটে লিখে দিয়েছিল মৃত্যুর কথা। মৃতদেহের শ্রাদ্ধও করা হয়েছে বারো বছর আগে, লাশটা পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে বলেও জানিয়েছিল শবদাহের দিন উপস্থিত থাকা সবাই। সেই মানুষটা কিনা জ্বলজ্যান্ত শরীরে ফিরে এসেছেন আবার! সবাই কেমন ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে, তাকে জিজ্ঞেস করা হয় অতীতের কথা, তিনি নিশ্চুপ থাকেন। লোকের মনে সন্দেহ বাড়ে, কিন্ত তার পরিচয় নিয়ে সংশয় দূর হয় না। বারো বছর আগে যিনি মরে গিয়েছিলেন, সেই মানুষ আবার ফিরে আসেন কিভাবে? এ তো অবিশ্বাস্য!

এই অবিশ্বাস্য ঘটনাটাই ঘটেছিল আজ থেকে একশো বছর আগে, এই বাংলাদেশেই, ঢাকার অদূরে গাজীপুরের জয়দেবপুরে। এই ঘটনাটা ইতিহাসে পরিচিত ‘ভাওয়াল সন্ন্যাসী রাজার মামলা’ নামে। যে ঘটনাটা নিয়ে সেই সময়ে পুরো ভারতবর্ষেই তোলপাড় শুরু হয়েছিল, সুদূর বিলেতেও সাড়া জাগিয়েছিল রাজা রমেন্দ্রনারায়ণের এই ফিরে আসার গল্পটা। জমিদারী ফিরে পাবার দাবীতে তিনি আদালতে গিয়েছিলেন, দীর্ঘ সিকি শতাব্দী ধরে চলেছিল সেই মামলা। চলুন, আজ আপনাদের শোনাই সেই চাঞ্চল্যকর ঘটনাটার ইতিবৃত্ত।

ইংরেজ আমল তখন, স্বাধীকারের দাবী ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে ভারতের বুকে। জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হয়নি তখনও। বাংলা অঞ্চলের সবচেয়ে দাপুটে জমিদার ছিলেন ভাওয়ালের জমিদার রাজেন্দ্রনারায়ণ। ১৮৭৮ সালে বৃটিশদের কাছ থেকে ‘রায়’ ও ‘রাজা’ উপাধি পান ভাওয়ালের জমিদার। রাজেন্দ্র নারায়ণ অবশ্য বেশিদিন জমিদার হিসেবে থাকেননি, তার মৃত্যুর পরে জমিদারী নিয়ে ঝামেলা শুরু হলো। জমিদার রাজেন্দ্র নারায়ণের যসখন মৃত্যু হয়, তখন তার তিন পুত্রই নাবালক। বৃটিশ সরকার তখন ভাওয়াল এস্টেটের জমিদারীতে হস্তক্ষেপ করে, একজন প্রশাসক নিয়োগ করা হয় দেখভালের জন্যে। ভাওয়াল এস্টেটের জমিদারী সীমানা ছিল প্রায় ছয়শো বর্গমাইল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ছিল। বর্তমান বাংলাদেশের গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ জেলা ছিল ভাওয়াল জমিদারীর অন্তর্ভূক্ত।

রাজেন্দ্র নারায়ণের তিন ছেলে সাবালক হবার পর তাদের হাতে এস্টেটের জমিদারীর ভার তুলে দেয়া হয়। এরমধ্যে মেজো ছেলে রমেন্দ্র নারায়ণ প্রজাদের মধ্যে বাকী দুই ভাইয়ের চেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। এমনিতে রমেন্দ্র নারায়ণ মানুষ খারাপ ছিলেন না, প্রজাবৎসলও ছিলেন। কিন্ত দুটো বাজে স্বভাব ছিল তার, পানের নেশা আর নারীর নেশা। শিকারের ভীষণ শখ ছিল তার, বিভাবতী নামের অনিন্দ্যসুন্দরী এক তরুণীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তার। কিন্ত শিকার বা বিভাবতী, কেউই তাকে মদ আর নারীসঙ্গ থেকে দূরে রাখতে পারেনি।

যা হবার তাই হলো একটা সময়ে, সিফিলিসে আক্রান্ত হলেন রমেন্দ্র নারায়ণ। স্ত্রীর সঙ্গে দূরত্ব আগে থেকেই ছিল তার, শোনা যায় বিভাবতীও নাকি স্বামীর আচরণে বিরক্ত হয়ে বহুগমনের পথ বেছে নিয়েছিলেন। রমেন্দ্র নারায়ণের ব্যক্তিগত চিকিৎসক আশুতোষ দাসগুপ্তের সঙ্গে রানী বিভাবতীর প্রণয় ছিল বলেও দাবী করেন কোন কোন ইতিহাসবিদ। ভাওয়াল এস্টেটের তখন মোটামুটি করুণ অবস্থা, রমেন্দ্র নারায়ন অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন, বাকী দুই ভাইও জমিদারী সামলানোর ব্যাপারে মনোযোগী ছিলেন না মোটেও। এরমধ্যে গল্পের খলচরিত্র হিসেবে এস্টেটে হাজির হলেন বিভাবতীর বড়ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী। জমিদারী সামলানোতে রাজেন্দ্রনারায়ণের ছেলেদের ব্যর্থতা দেখে এখানে জেঁকে বসলেন তিনি, জমিদার পরিবারের সদস্যদের চাইতেও বেশি প্রভাব নিয়ে চলাফেরা করতে শুরু করলেন সত্যেন্দ্রনাথ।

১৯০৯ সালের এপ্রিলে রমেন্দ্র নারায়ণের শরীর ভেঙে পড়লো ভীষণ। ঢাকার ডাক্তারদের চিকিৎসায় কোন উন্নতি হচ্ছিল না তার, ব্যক্তিগত চিকিৎসক আশুতোষ দাসগুপ্ত তাকে পরামর্শ দিলেন দার্জিলিং এ গিয়ে হাওয়া বদল করে আসতে। তাতে যদি কিছু হয়। সেখানে বনে বাদাড়ে শিকারও করা যাবে, এরকম লোভ দেখানো হয়েছিল রমেন্দ্র নারায়ণকে। দলবল নিয়ে দার্জিলিং যাত্রা করলেন ভাওয়াল এস্টেটের মেজোকুমার রমেন্দ্র নারায়ণ। রমেন্দ্র নারায়ণের সঙ্গে আরও ছিলেন রানী বিভাবতী, তার ভাই সত্যেন্দ্রনাথ, চিকিৎসক আশুতোষ দাসগুপ্তসহ আরও প্রায় বিশজন। যাত্রা শুরুর দুইদিন পর দার্জিলিঙে পৌঁছালেন তারা।

দার্জিলিঙে গিয়ে শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হলো রমেন্দ্র নারায়ণের। সেখান থেকে প্রতিদিন ভাওয়াল এস্টেটের জমিদারবাড়িতে মেজো কুমারের শারীরিক অবস্থার কথা জানিয়ে টেলিগ্রাম পাঠানো হতো। প্রথম টেলিগ্রামে তার ৯৯ ডিগ্রি জ্বর, পরের টেলিগ্রামে জ্বর বৃদ্ধি, পেটে যন্ত্রণা, দার্জিলিং সিভিল সার্জন দেখে গেছেন ইত্যাদি খবর আসতে থাকে। ওষুধ খাওয়া সত্ত্বেও বমি আর রক্ত মিশ্রিত পায়খানা হচ্ছিল। তবে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক খবরটা আসে মে মাসের সাত তারিখে। সেদিন এক টেলিগ্রামে জানানো হয়, ‘রমেন্দ্র নারায়ণ ইজ নো মোর!’ মৃত্যুর কারণ হিসেবে দার্জিলিঙের সিভিল সার্জন গলব্লাডারে পাথরের কথা উল্লেখ করেছিলেন।

পরদিন, ৮ই মে দার্জিলিঙেই মেজো কুমারের শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। গল্পের মূল রহস্যটা শুরু হয় এখান থেকেই। সেদিন প্রচণ্ড শিলাবৃষ্টি হয়েছিল। মেজো কুমারের দেহটা শ্মশানের বাইরে রাখা ছিল, কাঠকয়লা দিয়ে মুড়িয়ে। এরমধ্যেই শুরু হয়েছিল শিলাবৃষ্টি। সবাই শরীর বাঁচাতে ঢুকে পড়েছিল চাতালের ভেতরে। প্রায় ঘন্টাখানেক পর যখন বৃষ্টি থামলো, তখন রমেন্দ্র নারায়ণের মৃতদেহটা খুঁজে পাওয়া গেল না আর! যে কয়জন ছিলেন সেখানে উপস্থিত, তারা বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে কিছু না পেয়ে হাল ছেড়ে দিলেন। শ্মশানের শেয়াল কুকুরে মৃতদেহ নিয়ে গেছে ভেবে তারা চলে গেলেন শেষমেশ।

কয়েকদিন পরেই দার্জিলিং থেকে ফিরে এলেন রানী বিভাবতী আর বাকীরা। রমেন্দ্রনারায়ণের লাশ নিখোঁজের খবরটা ছড়িয়ে পড়তে দেরী হলো না। অনেকেই বদ্ধমূল ধারণা নিয়ে বসে রইলেন যে মেজো কুমার আসলে মারা যাননি, তিনি নিশ্চয়ই ফিরে আসবেন। দিন গেল, বছর গড়ালো, রমেন্দ্র নারায়ণ আর ফিরলেন না। ভাওয়াল এস্টেটের করুণ দশার আরও অবনতি হলো এর মধ্যে, রানী বিভাবতী আর তার ভাই সত্যেন্দ্রনাথ জমিদারবাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন কলকাতায়। রমেন্দ্র নারায়ণের বাকী দুই ভাইও মারা গেলেন বছরকয়েক বাদে। তিনজনই ছিলেন নিঃসন্তান, তাদের কোন উত্তরাধিকারীও ছিল না। ফলে বৃটিশ সরকার পুরো জমিদারী নিজেদের আয়ত্বে নিয়ে নিলো একটা সময়ে।

বারো বছর পরের একদিন, সাল ১৯২১। যে মে মাসে রমেন্দ্র নারায়ণ মারা গিয়েছিলেন, সেই মাসেই ঢাকার বাকল্যান্ড বাঁধ এলাকায় জটাধারী এক সুদর্শন সন্ন্যাসীর দেখা পাওয়া গেল। তার চেহারা অবিকল রমেন্দ্র নারায়ণের মতো! যারা রমেন্দ্র নারায়ণকে দেখেছে, তারা ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো এই সন্ন্যাসীকে দেখে। এক কান দুই কান হয়ে খবরটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগলো না খুব বেশি। ভাওয়াল এস্টেটেও এই খবর গিয়ে পৌঁছে গেলো। কাশিমপুরের জমিদার অতুল প্রসাদ রায়চৌধুরী তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন। খবর শুনে দলবেঁধে তাকে দেখতে এলেন এলাকার মানুষ। মৃত্যুর বারো বছর পরে মেজো কুমার ফিরে এসেছেন, এ তো চাট্টেখানি কথা নয়!

খবর দেয়া হলো রমেন্দ্র নারায়ণের ছোট বোন জ্যোতির্ময়ী দেবীকে। শ্বশুরবাড়ি থেকে ছুটে এলেন তিনি। সন্ন্যাসীকে দেখেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন জ্যোতির্ময়ী। একদম অবিকল তার মেজো ভাইয়ের মতো দেখতে এই লোক! শুধু জটাধরা চুল বাদে পুরো অবয়বটাই যেন রমেন্দ্র নারায়ণের। খালি গায়ের সন্ন্যাসীকে ভালো করে পরখ করলেন জ্যোতির্ময়ী, শিকারে গিয়ে কয়েকবার আঘাত পেয়েছিলেন রমেন্দ্র নারায়ণ, এছাড়াও শরীরে ছিল জন্মদাগ। মিলিয়ে দেখা হলো সেগুলো, শতভাগ মিলে গেল সব! সন্ন্যাসীকে জিজ্ঞেস করা হলো তার আসল পরিচয়ের ব্যাপারে, কিন্ত তিনি বেশিকিছু বললেন না, শুধু জানালেন, পরিবার ছেড়ে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেছেন তিনি। রমেন্দ্র নারায়ণ নামের কাউকে তিনি চিনতেন না বলেও জানিয়ে দিলেন। কিন্ত বেশিরভাগ মানুষই বিশ্বাস করলেন না তার কথা। লোকের আগ্রহে বিরক্ত হয়ে সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে চলে গেলেন সন্ন্যাসী।

কিছুদিন সেখানে কাটিয়ে আবার ঢাকায় ফিরলেন তিনি। আবার মানুষজন ভীড় করতে লাগলো তাকে দেখতে। তার ফিরে আসার খবর পেয়ে জমিদার অতুল প্রসাদ রায়চৌধুরী আবার তাকে নিয়ে গেলেন নিজের বাড়িতে। কয়েক এলাকার জমিদারেরা মিলে বসলেন আলোচনায়, একটা কিছু সিদ্ধান্ত তো নিতে হবে এই সন্ন্যাসীর ব্যাপারে। খবর এলো, সন্ন্যাসী গিয়ে বসেছেন ভাওয়াল এস্টেটের রাজবাড়ির সামনে, তাকে ঘিরে আছে উৎসুক জনতা। সম্ভবত তিনি ঠিক করেছেন, নীরবতা ভেঙে এবার মুখ খুলবেন। শুরু হলো প্রশ্নোত্তর পর্ব। সন্ন্যাসী মনে করতে পারলেন তার দুধ মায়ের নাম, সেটা রাজপরিবারের বাইরে আর কেউই জানতো না। রাজবাড়ির চিকিৎসক আশুতোষ দাসগুপ্ত ছিলেন সেখানে, তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, দার্জিলিঙে আসলে কি হয়েছিল? প্রতিটা ঘটনার সঠিক জবাব দিয়ে গেলেন সেই সন্ন্যাসী। ইনিই যে মেজো কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ, সেটা নিয়ে কারো আর সন্দেহ রইলো না।

সন্ন্যাসী দাবি করেন, তিনি দার্জিলিং-এ অসুস্থ হয়ে পড়ার আগের কথা মনে করতে পারেন না। জঙ্গলে নাগা সন্ন্যাসী সাধু ধর্মদাস তাঁকে বৃষ্টিভেজা অবস্থায় খুঁজে পায়, এবং সেবা করে বাঁচিয়ে তুলে। সেই থেকে নাগা সন্ন্যাসীকে গুরু মেনে তিনি সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে বছর দশেক ঘোরা ফেরা করার পরে তাঁর স্মৃতি ফেরত আসতে শুরু করে। তখন গুরুর আদেশে তিনি ভাওয়ালে ফিরে আসেন।

প্রমাণ যত অকাট্যই থাক, মেজকুমারকে মেনে নেওয়া গুটিকয়েক লোকের জন্য সম্ভব ছিল না। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রমেন্দ্র নারায়ণের স্ত্রী বিভাবতীর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। কারণ, তিনি ইতোমধ্যে মেজকুমারের জীবন বীমার ৩০ হাজার টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছেন। এ ছাড়া মেজকুমারের স্ত্রী হিসাবে বিভাবতী জমিদারির পক্ষ থেকে বাৎসরিক লক্ষাধিক টাকার যে ভাতা পেতেন তার পুরোটাই গ্রহণ করতেন সত্যেন্দ্রনাথ। তাই মেজকুমারের ফেরা সত্যেন্দ্রর জন্য ছিলো অশনিসংকেত।

ভাওয়াল এস্টেটের জমিদারী তখন বৃটিশ সরকারের অধীনে, সেটা ভোগ করছিলেন বিভাবতী দেবী এবং রমেন্দ্র নারায়ণের অন্য দুই ভাইয়ের স্ত্রীরা। সেই জমিদারী ফিরে পাবার জন্যে আদালতের দ্বারস্থ হলেন রমেন্দ্র নারায়ণ। ১৯৩০ সালের এপ্রিল ২৪ তারিখে ভাওয়াল সন্ন্যাসীর আইনজীবীরা বিভাবতী দেবী ও অন্যান্য মালিকদের বিরুদ্ধে ভাওয়াল এস্টেটের সম্পত্তির অধিকার চেয়ে মামলা করেন। শুরু হলো ঐতিহাসিক ‘ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলা’। দুইপক্ষই অজস্র যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছিল। বিভাবতী দেবীর উকিলের দাবী ছিল, রমেন্দ্র নারায়ণ শিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন, কিন্ত এই সন্ন্যাসী শিক্ষিত নন মোটেও। তবে বাদীপক্ষের আইনজীবীরা প্রমাণ করে দেখান যে, কুমার রমেন্দ্রনারায়ণও প্রায় নিরক্ষর ছিলেন।

বিবাদীপক্ষ আরো দাবী করে, মেজো কুমারের সিফিলিস রোগ শেষ পর্যায়ে পৌছে যাওয়ায় তাঁর গায়ে দগদগে ঘা ও ক্ষত থাকার কথা, কিন্তু সন্ন্যাসীর গায়ে তা নেই। সন্ন্যাসী মূলত উর্দু ভাষায় কথা বলতেন। তিনি দাবী করেন যে, ভ্রমণ করতে করতে তিনি বাংলা ভুলে গেছেন। কুমারের চোখের বর্ণ নিয়েও বিতর্ক উঠে। এটাও দাবী করা হয় যে, শ্মশানে কুমারের চিতায় অন্য কারো দেহ দাহ করা হয়েছে।

উভয় পক্ষ থেকে কয়েকশ সাক্ষী হাজির করা হয়। তাদের অনেকের সাক্ষ্য ছিলো পরস্পরবিরোধী। বিবাদী পক্ষ কুমারের বোন জ্যোতির্ময়ী দেবীকে জেরা করে। তিনি সন্ন্যাসীর পক্ষে ছিলেন, এবং দাবী করেন, সন্ন্যাসীই কুমার। তিনি আরো দাবী করেন, সন্ন্যাসীর চেহারায় তাঁদের বংশের ছাপ রয়েছে, এবং সন্ন্যাসী বাংলা বলতে পারেন। বাদীপক্ষ কুমারের স্ত্রী বিভাবতী দেবীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। বিভাবতী দেবী কুমারের চেহারার সাথে সন্ন্যাসীর চেহারার কোনো মিল নেই বলে দাবী করেন। কুমারের অন্য ভাইয়ের বিধবা স্ত্রী অন্নদা কুমারী দাবী করেন, কুমার রমেন্দ্রনারায়ন ইংরেজি বলতে পারতেন, এবং বাংলা বলতে ও লিখতে পারতেন। এর কোনোটাই সন্ন্যাসী পারতেন না। কিন্তু কুমারের ভাষাজ্ঞানের প্রমাণ হিসাবে পেশ করা চিঠিগুলো পরে জাল বলে প্রমাণিত হয়েছিল। একুশটা শারীরিক বৈষিষ্ট্য মিলিয়ে দেখা হয় দুজনের, সবগুলোই মিলে গিয়েছিল, শুধু আঙুলের ছাপটাই মিলিয়ে দেখা হয়নি, কারণ রমেন্দ্র নারায়ণের আঙুলের ছাপ সংগ্রহে ছিল না।

১৯৩৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ধর্মদাশ নাগা নামের এক ধর্মগুরু সাক্ষ্য দিতে আদালতে উপস্থিত হন। দোভাষীর মাধ্যমে তিনি জানান যে, ভাওয়াল সন্ন্যাসী হলো তাঁরই পূর্বতন শিষ্য সুন্দরদাস। পূর্বে মাল সিং নামধারী এই ব্যক্তি জাতিগতভাবে পাঞ্জাবী এবং লাহোরের নিবাসী শিখ ধর্মাবলম্বী। সাক্ষ্য দেয়ার সময়ে গুরু অসুস্থ্য হয়ে পড়েন, এবং তাঁর জেরা আদালত কক্ষের বাইরে নিতে হয়েছিলো। সন্ন্যাসীর সমর্থকেরা গুরু ধর্মদাসকে ভন্ড অভিহিত করে। উভয় পক্ষের সমাপনী যুক্তিতর্ক চলে ছয় সপ্তাহ ধরে। মামলার রায় দেয়ার পূর্বে শুনানি মুলতুবী করা হয় ১৯৩৬ সালের মে ২০ তারিখে।

এরকম অজস্র যুক্তিতর্ক শেষে ১৯৩৬ সালের আগস্ট ২৪ তারিখে বিচারক বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ রায় প্রদান করেন, এবং সন্ন্যাসীর পক্ষে রায় দেন। মামলার রায় ঘোষণার দিন আদালত প্রাঙ্গনে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। সন্ন্যাসীকে রমেন্দ্র নারায়ণ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে তাকে জমিদারীর একটা অংশ বুঝিয়ে দেয়ার রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই বাইরে প্রায় উৎসবের আবহ শুরু হয়ে গিয়েছিল। মামলার রায় দেয়ার পরেই এই মামলার বিচারক পান্নাবল বসু বিচারকের পদ থেকে অবসর নেন। জমিদারী সম্পত্তির দখল নিয়ে রমেন্দ্র নারায়ণের করা আরেকটা মামলার বিচারকাজ চলছিল তখন। এর মাঝে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে অনেকদিন সেটার কাজ বন্ধ ছিল। জার্মান বিমান হামলায় কাউন্সিলের কক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় প্রিভি কাউন্সিলের অধিবেশন ঘটে হাউজ অফ লর্ডসে, ১৯৪৫ সালে সেখানেই শুনানি শুরু হয়। ১৯৪৬ সালের জুলাই মাসের ৩০ তারিখে বিচারকেরা দাবিদারের পক্ষে রায় দেন, এবং আপিল নাকচ করে দেন। পরের দিন কলকাতায় টেলিগ্রাফ মারফত মামলার রায় জানানো হয়।

তবে জমিদারী সম্পত্তি বুঝে পেলেও সেটা ভোগ করতে পারেননি সন্ন্যাসী হয়ে ফিরে আসা রমেন্দ্র নারায়ণ। রায় ঘোষণার মাত্র কয়েকদিন পরেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। পার্থিব সম্পত্তির লোভ-লালসা অনেক আগেই ফুরিয়ে গিয়েছিল তার। ভাওয়াল রাজার ফিরে আসার এই অবিশ্বাস্য গল্পটা নিয়ে অজস্র নাটক বানানো হয়েছে, টালিগঞ্জে তো সন্ন্যাসী রাজা নামের একটা সিনেমাও বানানো হয়েছে এই গল্পকে উপজীব্য করে। মহানায়ক উত্তম কুমার সেখানে রমেন্দ্র নারায়ণের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। কলকাতার বিখ্যাত পরিচালক সৃজিত মূখার্জীর পরবর্তী সিনেমা ‘এক যে ছিল রাজা’র গল্পটাও এই ভাওয়াল রাজাকে নিয়েই। মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন যীশু সেনগুপ্ত।





কত অদ্ভুত আর বিস্ময়কর ঘটনা ছড়িয়ে আছে আমাদের চারপাশে, সেগুলোর কতখানিই বা আমরা জানি? ভাওয়াল রাজার রহস্যময় অন্তর্ধান বা পুনরুদ্ধারের এই ঘটনাটাই বা কয়জন জানে? সন্ন্যাসী রাজাই বলি, কিংবা মেজো কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ- তার সবটুকু স্মৃতি ধারণ করে ঢাকার অদূরে গাজীপুরে এখনও স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে ভাওয়াল এস্টেট রাজবাড়িটি।






নাম

অর্থ ও বাণিজ্য,235,আন্তর্জাতিক,731,কাপাসিয়া,342,কালিয়াকৈর,417,কালীগঞ্জ,253,খেলা,644,গাজীপুর,3936,চাকরির খবর,33,জয়দেবপুর,1581,জাতীয়,2958,টঙ্গী,911,তথ্যপ্রযুক্তি,512,ধর্ম,196,পরিবেশ,136,প্রতিবেদন,310,বিজ্ঞান,55,বিনোদন,697,ভিডিও,58,ভিন্ন খবর,142,ভ্রমন,115,মুক্তমত,27,রাজধানী,829,রাজনীতি,1055,লাইফস্টাইল,283,শিক্ষাঙ্গন,398,শীর্ষ খবর,10757,শ্রীপুর,481,সাক্ষাৎকার,12,সারাদেশ,649,স্বাস্থ্য,212,
ltr
item
GazipurOnline.com: ভাওয়াল রাজা: মৃত্যুর বারো বছর পর ফিরে এসেছিলেন যে
ভাওয়াল রাজা: মৃত্যুর বারো বছর পর ফিরে এসেছিলেন যে
https://2.bp.blogspot.com/-cajefdZmU3Y/W-3QavKmD6I/AAAAAAAAaBE/2dQdUstv4WYnoqfaKz0ou0NXLHaGyJJuwCLcBGAs/s400/vawal-5-1.jpg
https://2.bp.blogspot.com/-cajefdZmU3Y/W-3QavKmD6I/AAAAAAAAaBE/2dQdUstv4WYnoqfaKz0ou0NXLHaGyJJuwCLcBGAs/s72-c/vawal-5-1.jpg
GazipurOnline.com
https://www.gazipuronline.com/2018/11/vaowalraza.html
https://www.gazipuronline.com/
https://www.gazipuronline.com/
https://www.gazipuronline.com/2018/11/vaowalraza.html
true
13958681640745950
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Read More Reply Cancel reply Delete By প্রচ্ছদ PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share. STEP 2: Click the link you shared to unlock Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy