উদ্বোধনের আগেই দেবে যাচ্ছে ঢাকা-টাঙ্গাইল ৪ লেন


সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে জয়দেবপুর-চন্দ্রা-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা মহাসড়কটি নির্মাণ করছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর। ৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়কের প্রতি কিলোমিটারের নির্মাণব্যয় ৫৮ কোটি টাকারও বেশি। চার লেনের এ মহাসড়ক আগামী বছরের জুনের মধ্যে উদ্বোধন হওয়ার কথা। কিন্তু উদ্বোধনের আগেই দেবে যাচ্ছে সড়কটি।

দেবে যাওয়ার মাত্রা এলেঙ্গা-টাঙ্গাইলের পাঁচ-সাত কিলোমিটার অংশে বেশি। কোথাও কোথাও দেড়-দুই ইঞ্চি পর্যন্ত দেবে যাচ্ছে পিচ।

সড়ক দেবে যাওয়ার এ সমস্যাকে প্রকৌশলীদের ভাষায় বলা হয় ‘রাটিং’। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় সড়ক গবেষণাগারের প্রকৌশলীরা বলছেন, পিচের জন্য পাথর-বিটুমিনের যে মিশ্রণ তৈরি করা হয়, সেটি ঠিকমতো না হলে রাটিং বা সড়ক দেবে যেতে পারে। সড়ক দেবে যাওয়ার আরেকটি কারণ যানবাহনের ‘ওভারলোড’। এর বাইরে দুর্বল নকশা বা দুর্বল নির্মাণকাজের কারণেও সড়ক দেবে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন তারা। এছাড়া মাটির ধাপগুলোতে ঠিকমতো রোলিংয়ের কাজ না করা হলেও রাটিং দেখা দিতে পারে। একই সমস্যায় পড়েছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কও। এ কারণে উদ্বোধনের এক বছরের মাথায় হাজার কোটি টাকার বেশি সংস্কারকাজের প্রয়োজন পড়ে সড়কটিতে।

উদ্বোধনের আগেই সড়কটি এভাবে দেবে যাওয়ায় নিজেদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে মনে করছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। অন্যদিকে স্থানীয়দের অভিযোগ, নিম্নমানের কাজের কারণেই নষ্টের পথে উত্তরাঞ্চলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ সড়ক। একই কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরাও।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, এটার জন্য দায়ী নিম্নমানের নির্মাণকাজ। সড়কের পিচটা থাকে সবার উপরে। তার নিচে থাকে মাটি। একাধিক ধাপে মাটির বেজ, সাব-বেজ তৈরি করতে হয়। প্রতিটা ধাপে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ মানদণ্ড থাকে। যখন এসব বেজ, সাব-বেজে নিম্নমানের কাজ হয়, তখনই কিন্তু পিচটা দেবে যায়। ফাউন্ডেশন যদি দুর্বল হয়, তাহলে পিচ যত যত্ন করেই বানানো হোক না কেন, সেটি নষ্ট হবেই। এখানে মাটির বেজে নিম্নমানের কাজ হয়েছে।

সব মিলিয়ে চারটি প্যাকেজে চলছে ঢাকা-টাঙ্গাইল চার লেন মহাসড়কের নির্মাণকাজ। এর মধ্যে প্যাকেজ-৪-এ পড়েছে এলেঙ্গা-টাঙ্গাইলের ১০ কিলোমিটার। দক্ষিণ কোরিয়ার জিডিসিএলের এ অংশের নির্মাণকাজ করছে ঢাকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ডিয়েনকো লিমিটেড। কাজের চুক্তিমূল্য ৩৫৬ কোটি টাকা।

উদ্বোধনের আগে সড়ক দেবে যাওয়ার জন্য নিম্নমানের নির্মাণকাজকে দায়ী করা হলেও তা মানতে নারাজ প্রকল্পের পরিচালক এবং নির্মাণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

অভিযোগ প্রসঙ্গে ‘সাসেক সংযোগ প্রকল্প: জয়দেবপুর-চন্দ্রা-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা সড়ক (এন-৪) চার লেন মহাসড়কে উন্নীতকরণ’ প্রকল্পের পরিচালক মো. ইসহাক বলেন, নিম্নমানের নির্মাণকাজের জন্য এমন সমস্যা হয়নি। দেবে যাওয়ার একটা কারণ হতে পারে ওভারলোডের যানবাহনের চলাচল ও অতিরিক্ত ট্রাফিক।

প্রকল্প পরিচালক মো. ইসহাকের সুরেই কথা বলেছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ডিয়েনকো লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম খোরশেদ আলম। তিনি বলেন, দেবে যাওয়া আর রাটিং কিন্তু এক জিনিস না। রাটিংটা হয় সড়কের নির্দিষ্ট অংশে, যেদিক দিয়ে গাড়ির চাকা বেশি পড়ে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি একটি সাধারণ সমস্যা। শুধু এলেঙ্গা-টাঙ্গাইলের ৪ নম্বর প্যাকেজে নয়, পুরো সড়কেই রাটিং সমস্যা দেখা দিয়েছে। যেদিক দিয়ে গাড়ির চাকা বেশি পড়ে, সেই অংশে রাটিং তৈরি হয়। দুটি কারণে এ সমস্যা হচ্ছে। প্রথম কারণ হলো ওভারলোডিং। দ্বিতীয় কারণটি হলো সড়কের ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যানবাহন চলাচল।

অন্যদিকে ‘ওভারলোডে গাড়ির কারণে রাটিং হচ্ছে’, এটিকে দায় এড়ানো ও অবৈজ্ঞানিক যুক্তি হিসেবে দেখছেন বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক। ১৯৯৮ সালে চালু হওয়া যমুনা সেতুর সংযোগ সড়কের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, নতুন সড়কটিতে ওঠার আগে এই ওভারলোডেড গাড়িগুলো কিন্তু যমুনা সেতুর সংযোগ সড়ক দিয়ে আসছে। কই সেটিতে তো এখনো রাটিং দেখা দেয়নি? যারা ‘ওভারলোডেড’, ‘ওভার ট্রাফিকের’ কথা বলছে, তারা আসলে একটা দায়সারা কথা বলছে, যেটার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।

তিনি বলেন, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে এখানে ওভারলোডিংটা কোনো ফ্যাক্টর না। সমস্যাটা নির্মাণে। রাস্তার নির্মাণকাজটাই আসলে এখানে ভালো হয়নি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক রাটিং হওয়া থেকে আমরা ঠেকাতে পারলাম না। এখন ঢাকা-টাঙ্গাইলেও আমরা পারছি না। এটা কিন্তু ভীষণ শঙ্কার। কারণ সামনে আরো অনেকগুলো সড়ক কিন্তু আমাদের সরকার বানানোর উদ্যোগ নিয়েছে। তাই বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। ওভারলোড বা অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে সড়ক দেবে যাচ্ছে, এমন মন্তব্য করে দায় এড়ানো যাবে না।

ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদিত হয় ২০১৩ সালে। কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালে। চার প্যাকেজে কাজ হচ্ছে। প্রথমটি গাজীপুরের ভোগরা বাজার ইন্টারচেঞ্জ থেকে কালিয়াকৈর বাইপাস ইন্টারসেকশন পর্যন্ত ১৯ কিলোমিটার। এর কাজ করছে দক্ষিণ কোরিয়ার কায়রইঙ ও বাংলাদেশের স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড।

দ্বিতীয় প্যাকেজে টাঙ্গাইল থেকে কালিয়াকৈর বাইপাস ইন্টারসেকশন পর্যন্ত আরো ১৯ কিলোমিটার নির্মাণ করছে বাংলাদেশের আব্দুল মোনেম লিমিটেড ও মালয়েশিয়ার এইচসিএম ইঞ্জিনিয়ারিং। তৃতীয় প্যাকেজে দুল্লামারী রোড থেকে টাঙ্গাইল পর্যন্ত ২২ দশমিক ৪০ কিলোমিটার মহাসড়ক চার লেনে উন্নয়ন করছে দক্ষিণ কোরিয়ার সামহোয়ান ও বাংলাদেশের মীর আখতার। ধীরে ধীরে নির্মাণাধীন মহাসড়কটির পুরোটা জুড়েই রাটিং দেখা দেয়ার শঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গত ২১ ও ২২ জুন মহাসড়কটি পরিদর্শন করেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের ‘মনিটরিং টিম ১২’। পরিদর্শনকালে তারাও এলেঙ্গা থেকে ঢাকার দিকে পাঁচ-সাত কিলোমিটার রাটিং দেখতে পেয়েছেন। মনিটরিং টিম ১২-এর পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাটিং হওয়া কয়েকটি জায়গায় মেশিন দিয়ে কেটে মেরামত করা হয়েছে, যা দেখে মনে হচ্ছে পুরনো মেরামত করা সড়ক। সদ্য নির্মিত মহাসড়ক আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের আগে এ ধরনের রাটিং কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। রাটিংয়ের মাত্রা ক্রমান্বয়ে ঢাকার দিকে এগোচ্ছে। এতে নির্মাণকাজের প্রতি জনসাধারণ নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করছে। অন্যদিকে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হচ্ছে। কারিগরি টিম গঠন করে রাটিংয়ের কারণ অনুসন্ধান করে দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করার জন্য মতামত দিয়েছে এই মনিটরিং টিম।


 

COMMENTS





নাম

অর্থ ও বাণিজ্য,234,আন্তর্জাতিক,731,কাপাসিয়া,342,কালিয়াকৈর,417,কালীগঞ্জ,253,খেলা,643,গাজীপুর,3927,চাকরির খবর,33,জয়দেবপুর,1581,জাতীয়,2955,টঙ্গী,911,তথ্যপ্রযুক্তি,512,ধর্ম,196,পরিবেশ,136,প্রতিবেদন,310,বিজ্ঞান,55,বিনোদন,697,ভিডিও,58,ভিন্ন খবর,142,ভ্রমন,115,মুক্তমত,27,রাজধানী,828,রাজনীতি,1055,লাইফস্টাইল,282,শিক্ষাঙ্গন,398,শীর্ষ খবর,10745,শ্রীপুর,481,সাক্ষাৎকার,12,সারাদেশ,649,স্বাস্থ্য,212,
ltr
item
GazipurOnline.com: উদ্বোধনের আগেই দেবে যাচ্ছে ঢাকা-টাঙ্গাইল ৪ লেন
উদ্বোধনের আগেই দেবে যাচ্ছে ঢাকা-টাঙ্গাইল ৪ লেন
https://1.bp.blogspot.com/-Hneb16tggMY/XSB5X6MtFCI/AAAAAAAAc38/Q5WBy9E-y2g9cSR7MV-Ink72VMROjhhfACLcBGAs/s1600/4lan.PNG
https://1.bp.blogspot.com/-Hneb16tggMY/XSB5X6MtFCI/AAAAAAAAc38/Q5WBy9E-y2g9cSR7MV-Ink72VMROjhhfACLcBGAs/s72-c/4lan.PNG
GazipurOnline.com
https://www.gazipuronline.com/2019/07/4lan.html
https://www.gazipuronline.com/
https://www.gazipuronline.com/
https://www.gazipuronline.com/2019/07/4lan.html
true
13958681640745950
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Read More Reply Cancel reply Delete By প্রচ্ছদ PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share. STEP 2: Click the link you shared to unlock Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy