‘ক্ষমা করে দিও। তুমি ছেলে-মেয়ে নিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের সাথে মিশে যেও। কবে দেখা হবে জানি না।’ কথাগুলো বঙ্গতাজ-খ্যাত তাজউদ্দীন আহমদের। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ রাতে লুঙ্গি পাঞ্জাবী পড়ে একটা কাপড়ের ব্যাগ, একটা রাইফেল ও পিস্তল নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে অজানার পথে পাড়ি জমান তিনি।
বিদায় বেলায় স্ত্রীর উদ্দেশ্যে মর্মস্পর্শী এই কথাগুলো লিখে যান মুক্তিযুদ্ধের এই মহাপুরুষ। ১৯৭১ সালে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণে এই ভূ-খণ্ডের মুক্তিকামী মানুষের যখন চরম দুঃসময় চলছিল, তখন কারারুদ্ধ বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে কাণ্ডারীবিহীন নিপীড়িত মানুষের হাল ধরার জন্য তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।
বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ৯৪তম জন্মবার্ষিকী আজ। ১৯২৫ সালের এই দিনে গাজীপুরের কাপাসিয়া থানার দরদরিয়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকে এ দেশে ভাষার অধিকার, অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী যত আন্দোলন হয়েছে, তার প্রতিটিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তিনি অসামান্য ভূমিকা রাখেন।
তাজউদ্দীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা, সততা ও আদর্শবাদের অনন্য এক প্রতীক। তিনি ছাত্রজীবনেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন। প্রচণ্ড মেধাবী তাজউদ্দীন স্কুল জীবনে কোন পরীক্ষায় প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হননি। ষষ্ঠ শ্রেণিতে স্কলারশীপে ঢাকা জেলায় প্রথম, এসএসসিতে বোর্ডে ১২তম এবং এইচএসসিতে চতুর্থ হয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে সম্মানে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন এবং ছাত্রাবস্থায় কম বয়সেই এমএলএ নির্বাচিত হন। এরপর জেলে আটক অবস্থায় আইন শাস্ত্রেও স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি গঠিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের (বর্তমানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। ১৯৪৮-এর ১১ এবং ১৩ মার্চ সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে ধর্মঘট-কর্মসূচি ও বৈঠক করেন৷ ২৪ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতারাসহ তিনি বৈঠক করেন৷ তিনি ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। ছিলেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্যও। আওয়ামী লীগের গঠন-প্রক্রিয়ার মূল উদ্যোক্তাদের একজন তিনি। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত ঢাকা জেলা আওয়ামী মুসলিম লীগের (১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় আওয়ামী লীগ) সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫৪-এর নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী হিসেবে মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদককে পরাজিত করে পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। একই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ওই বছরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তিসনদ ৬ দফা ঘোষণা করেন। ৬ দফার অন্যতম রূপকার ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর সামরিক শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় ১৯৭১ সালের মার্চে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। এ আন্দোলন পরিচালনায় তাজউদ্দীন আহমদ যথেষ্ট সাংগঠনিক দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন। এরপর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার ও একতরফা হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। শুরু হয় বাঙালির সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তখন মূল কাণ্ডারির ভূমিকা পালন করেন তাজউদ্দীন আহমদ।
তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি ১৯৭১ সালে এক চরম সংকটময় মুহূর্তে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে সফল ভূমিকা পালন। নানা পরিক্রমা পেরিয়ে যুদ্ধ চলাকালীন ১০ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ ঘোষণা করা হয়। ১১ এপ্রিল তাজউদ্দীন বেতারে ভাষণ দেন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে আনুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। তাজউদ্দীন আহমদ হন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। অস্থায়ী সরকার ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত কলকাতা থেকে কার্য পরিচালনা করে। তাজউদ্দীন আহমদ দৃঢ়তা ও নিষ্ঠার সাথে এতে নেতৃত্ব দেন।
১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠনের পর তাজউদ্দিন আহমদ ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে সাথে নিয়ে ভারতের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু ভারতের সীমান্তে পৌঁছে, তিনি বিনা প্রটোকলে ভারতে প্রবেশ করেন নাই। তিনি ওই সময় বলেন, একটি স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অন্য দেশে তিনি কোনো প্রটোকল ও আমন্ত্রণ ছাড়া প্রবেশ করতে পারেন না। এটা করলেও তার দেশের জন্য অসম্মানজনক। অতঃপর ওপারের ভারতীয় বাহিনী তাকে গার্ড অব অনার দিয়ে ভারতে নিয়ে যান।
২২ ডিসেম্বর তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দ ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে আসলে তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান। তিনি অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭৩-এ ঢাকা-২২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন৷ বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় বাজেট পেশ করেন, প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন।
১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলের সমাপনী অধিবেশনের বক্তৃতায় তিনি দল, সরকার এবং নেতা ও কর্মীদের মাঝে দূরত্ব দূর করে, সংগঠন এবং সরকারের মাঝে এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের প্রতি আহ্বান জানান৷ অথচ, পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর সাথে তাজউদ্দীনের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধু তাঁর দীর্ঘ ৩০ বছরের বিশ্বস্ত রাজনৈতিক সহকর্মীকে ভুল বোঝেন।
১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর তাজউদ্দীন মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। যুদ্ধাকালীন সময়ে অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ একটি কাঠের চৌকিতে ঘুমাতেন। নিজের কাপড় নিজেই ধুতেন। ২৪ ঘণ্টার ভেতর ২০ ঘণ্টাই মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাজ করতেন, ঘুমাতেন মাত্র ২ ঘণ্টা। প্রকৃতপক্ষে তাজউদ্দীনের মত মেধাবী ও বিশ্বস্ত সারথির কারণেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নগুলো বাস্তবে ডানা মেলতে পেরেছিল।
‘তাজউদ্দীন হিন্দু, আসল নাম লক্ষণ সিং। আসলে তিনি শিখ মেজর নাম ত্যাজারাম সিং। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় ভারত প্যারাসুট দিয়ে এই দেশে নামিয়ে দিয়ে গেছে।’ তাজউদ্দীনের পগোজ স্কুলের সহপাঠি ড. কামাল হোসেনকে জেরার সময় পাকিস্তানি গোয়েন্দারা এভাবেই তাজউদ্দীনের পরিচয় দিচ্ছিলেন। পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী জেনারেল রাও ফরমান আলি তার বইতে লিখেছেন, ‘তাজ উদ্দীন গোঁরা ভারতপন্থী আওয়ামী লীগার...। তিনি আট বছর বয়স পর্যন্ত হিন্দু ছিলেন বলে একটি প্রচারণা আছে।’ পাকিস্তানিরা যাই বলুক, প্রকৃতপক্ষে তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন একজন ধার্মিক এবং কোরআনে হাফেজ। ধার্মিক হলেও তিনি ধর্ম নিয়ে রাজনীতির ঘোরতর বিরোধী ছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকচক্র বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর তাজউদ্দীন আহমদকে গৃহবন্দি করা হয়। পরবর্তীতে তাকে জেলখানায় রাখা হয়। খুনি মোস্তাকের মন্ত্রীসভায় যোগদান করাতে অস্বীকৃতি জানালে জননেতা তাজ উদ্দীনসহ ৪ জাতীয় নেতাকে জেলে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
তাজউদ্দিন আহমদ ছিলেন একজন বিদগ্ধ ও বিচক্ষণ রাজনীতিক। তার দূরদর্শী নেতৃত্ব অতি দুঃসময়ে জাতিকে সঙ্গবদ্ধ ও সুসংগঠিত রেখেছিল। তিনি একজন সাহিত্যিকও বটে। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব, যুদ্ধ চলাকালীন এবং পরবর্তী সময়ের নানা ঘটনা তিনি নিয়মিত ডায়েরীতে লিপবদ্ধ করতেন। যা থেকে পরবর্তী সময়ে প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের জন্য তাজউদ্দিন আহমদের অবদান ও তার স্মৃতির প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।
বিদায় বেলায় স্ত্রীর উদ্দেশ্যে মর্মস্পর্শী এই কথাগুলো লিখে যান মুক্তিযুদ্ধের এই মহাপুরুষ। ১৯৭১ সালে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণে এই ভূ-খণ্ডের মুক্তিকামী মানুষের যখন চরম দুঃসময় চলছিল, তখন কারারুদ্ধ বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে কাণ্ডারীবিহীন নিপীড়িত মানুষের হাল ধরার জন্য তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।
বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ৯৪তম জন্মবার্ষিকী আজ। ১৯২৫ সালের এই দিনে গাজীপুরের কাপাসিয়া থানার দরদরিয়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকে এ দেশে ভাষার অধিকার, অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী যত আন্দোলন হয়েছে, তার প্রতিটিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তিনি অসামান্য ভূমিকা রাখেন।
তাজউদ্দীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা, সততা ও আদর্শবাদের অনন্য এক প্রতীক। তিনি ছাত্রজীবনেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন। প্রচণ্ড মেধাবী তাজউদ্দীন স্কুল জীবনে কোন পরীক্ষায় প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হননি। ষষ্ঠ শ্রেণিতে স্কলারশীপে ঢাকা জেলায় প্রথম, এসএসসিতে বোর্ডে ১২তম এবং এইচএসসিতে চতুর্থ হয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে সম্মানে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন এবং ছাত্রাবস্থায় কম বয়সেই এমএলএ নির্বাচিত হন। এরপর জেলে আটক অবস্থায় আইন শাস্ত্রেও স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি গঠিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের (বর্তমানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। ১৯৪৮-এর ১১ এবং ১৩ মার্চ সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে ধর্মঘট-কর্মসূচি ও বৈঠক করেন৷ ২৪ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতারাসহ তিনি বৈঠক করেন৷ তিনি ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। ছিলেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্যও। আওয়ামী লীগের গঠন-প্রক্রিয়ার মূল উদ্যোক্তাদের একজন তিনি। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত ঢাকা জেলা আওয়ামী মুসলিম লীগের (১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় আওয়ামী লীগ) সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫৪-এর নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী হিসেবে মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদককে পরাজিত করে পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। একই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ওই বছরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তিসনদ ৬ দফা ঘোষণা করেন। ৬ দফার অন্যতম রূপকার ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর সামরিক শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় ১৯৭১ সালের মার্চে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। এ আন্দোলন পরিচালনায় তাজউদ্দীন আহমদ যথেষ্ট সাংগঠনিক দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন। এরপর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার ও একতরফা হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। শুরু হয় বাঙালির সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তখন মূল কাণ্ডারির ভূমিকা পালন করেন তাজউদ্দীন আহমদ।
তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি ১৯৭১ সালে এক চরম সংকটময় মুহূর্তে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে সফল ভূমিকা পালন। নানা পরিক্রমা পেরিয়ে যুদ্ধ চলাকালীন ১০ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ ঘোষণা করা হয়। ১১ এপ্রিল তাজউদ্দীন বেতারে ভাষণ দেন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে আনুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। তাজউদ্দীন আহমদ হন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। অস্থায়ী সরকার ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত কলকাতা থেকে কার্য পরিচালনা করে। তাজউদ্দীন আহমদ দৃঢ়তা ও নিষ্ঠার সাথে এতে নেতৃত্ব দেন।
১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠনের পর তাজউদ্দিন আহমদ ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে সাথে নিয়ে ভারতের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু ভারতের সীমান্তে পৌঁছে, তিনি বিনা প্রটোকলে ভারতে প্রবেশ করেন নাই। তিনি ওই সময় বলেন, একটি স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অন্য দেশে তিনি কোনো প্রটোকল ও আমন্ত্রণ ছাড়া প্রবেশ করতে পারেন না। এটা করলেও তার দেশের জন্য অসম্মানজনক। অতঃপর ওপারের ভারতীয় বাহিনী তাকে গার্ড অব অনার দিয়ে ভারতে নিয়ে যান।
২২ ডিসেম্বর তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দ ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে আসলে তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান। তিনি অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭৩-এ ঢাকা-২২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন৷ বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় বাজেট পেশ করেন, প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন।
১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলের সমাপনী অধিবেশনের বক্তৃতায় তিনি দল, সরকার এবং নেতা ও কর্মীদের মাঝে দূরত্ব দূর করে, সংগঠন এবং সরকারের মাঝে এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের প্রতি আহ্বান জানান৷ অথচ, পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর সাথে তাজউদ্দীনের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধু তাঁর দীর্ঘ ৩০ বছরের বিশ্বস্ত রাজনৈতিক সহকর্মীকে ভুল বোঝেন।
১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর তাজউদ্দীন মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। যুদ্ধাকালীন সময়ে অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ একটি কাঠের চৌকিতে ঘুমাতেন। নিজের কাপড় নিজেই ধুতেন। ২৪ ঘণ্টার ভেতর ২০ ঘণ্টাই মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাজ করতেন, ঘুমাতেন মাত্র ২ ঘণ্টা। প্রকৃতপক্ষে তাজউদ্দীনের মত মেধাবী ও বিশ্বস্ত সারথির কারণেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নগুলো বাস্তবে ডানা মেলতে পেরেছিল।
‘তাজউদ্দীন হিন্দু, আসল নাম লক্ষণ সিং। আসলে তিনি শিখ মেজর নাম ত্যাজারাম সিং। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় ভারত প্যারাসুট দিয়ে এই দেশে নামিয়ে দিয়ে গেছে।’ তাজউদ্দীনের পগোজ স্কুলের সহপাঠি ড. কামাল হোসেনকে জেরার সময় পাকিস্তানি গোয়েন্দারা এভাবেই তাজউদ্দীনের পরিচয় দিচ্ছিলেন। পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী জেনারেল রাও ফরমান আলি তার বইতে লিখেছেন, ‘তাজ উদ্দীন গোঁরা ভারতপন্থী আওয়ামী লীগার...। তিনি আট বছর বয়স পর্যন্ত হিন্দু ছিলেন বলে একটি প্রচারণা আছে।’ পাকিস্তানিরা যাই বলুক, প্রকৃতপক্ষে তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন একজন ধার্মিক এবং কোরআনে হাফেজ। ধার্মিক হলেও তিনি ধর্ম নিয়ে রাজনীতির ঘোরতর বিরোধী ছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকচক্র বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর তাজউদ্দীন আহমদকে গৃহবন্দি করা হয়। পরবর্তীতে তাকে জেলখানায় রাখা হয়। খুনি মোস্তাকের মন্ত্রীসভায় যোগদান করাতে অস্বীকৃতি জানালে জননেতা তাজ উদ্দীনসহ ৪ জাতীয় নেতাকে জেলে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
তাজউদ্দিন আহমদ ছিলেন একজন বিদগ্ধ ও বিচক্ষণ রাজনীতিক। তার দূরদর্শী নেতৃত্ব অতি দুঃসময়ে জাতিকে সঙ্গবদ্ধ ও সুসংগঠিত রেখেছিল। তিনি একজন সাহিত্যিকও বটে। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব, যুদ্ধ চলাকালীন এবং পরবর্তী সময়ের নানা ঘটনা তিনি নিয়মিত ডায়েরীতে লিপবদ্ধ করতেন। যা থেকে পরবর্তী সময়ে প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের জন্য তাজউদ্দিন আহমদের অবদান ও তার স্মৃতির প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।
COMMENTS