রাতের আঁধারে রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণ করে কারা?


বাইরের দিক থেকে এই শরণার্থী ক্যাম্প আপাতত শান্ত মনে হলেও ভেতরে-ভেতরে অস্থিরতা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। ক্যাম্পের ভেতরে দিনের বেলায় এক রকম চিত্র থাকলেও রাতের বেলায় চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। রাতের আঁধার নামার সাথে সাথেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সশস্ত্র পদচারণা শুরু হয়।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিদ্যুত সরবরাহ নেই। অন্যদিকে পর্যাপ্ত রাস্তাও নেই। ক্যাম্পের ভেতরে বড় কয়েকটি সড়ক তৈরি করা হয়েছে যেগুলো 'আর্মি রোড' হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এসব রাস্তার মাধ্যমে সব জায়গায় পৌছনো যায়না।

এমন অনেক জায়গা আছে যেকানে পৌঁছাতে পাহাড়ি উঁচু-নিচু রাস্তায় অনেকক্ষণ হাঁটতে হয়। ফলে যে কোন অপরাধ করে দ্রুত সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব। রাতের বেলায় এসব জায়গায় যেতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও নিরাপদ বোধ করেন না। শরণার্থী শিবিরে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলে জানা গেল, ক্যাম্পের ভেতরে একটি অংশ আছে যাদের 'কাফের' বা বিশ্বাসঘাতক হিসেবে সন্দেহ করে অপরপক্ষ।

এসব ব্যক্তি এখনো ক্যাম্প থেকে মিয়ানমারের গোয়েন্দাদের তথ্য দেয় বলে তাদের প্রতিপক্ষের অভিযোগ। ক্যাম্পের ভেতরেই একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে যারা তাদের দৃষ্টিতে 'কাফের' চিহ্নিত করার কাজ করে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা মুহাম্মদ ইউনুস দোভাষীর সাহায্যে আমাকে বলেন,"যাদের হত্যা করা হয়েছে তারা সবাই মোনাফেক। কোন ভালো মানুষকে হত্যা করা হয়নি।"

তিনি বলেন, ক্যাম্পের ভেতরে অনেকে আছে যারা মিয়ানমার বাহিনীর কাছে 'তথ্য পাচার' করে। পুলিশ বলছে, ক্যাম্পের ভেতরে রোহিঙ্গাদের নিজেদের মধ্যে গত দুই বছরে অন্তত ৪৫টি খুন হয়েছে, যার বেশকিছু পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সূত্রগুলো বলছে, ক্যাম্পের ভেতরে তৎপর সশস্ত্র গোষ্ঠীর কথা না শুনলে পরিণতি হয় ভয়াবহ।

হত্যাকাণ্ডের আরেকটি কারণ আছে। স্থানীয় প্রশাসনের এবং নিরাপত্তাবাহিনীর সাথে কথা বলে সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেল। রোহিঙ্গাদের মধ্যে গত দুই বছরে ক্যাম্পের ভেতরে যারা কিছুটা প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন তাদের বেশ কয়েকজনকে হত্যা কারা হয়েছে। কারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যেই অনেকে চায়না যে অন্য কেউ প্রভাবশালী হয়ে উঠুক।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে বোঝা গেল, এই সশস্ত্র গোষ্ঠী ক্যাম্পের ভেতরে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে বলেন, " ক্যাম্পের ভেতরে একটা কথা প্রচলিত আছে, ক্যাম্প দিনের বেলায় বাংলাদেশের আর রাতের বেলায় সশস্ত্র গোষ্ঠীর। এটা এখন ওপেন সিক্রেট।"

কর্মকর্তারা বলছেন, এই সশস্ত্র গোষ্ঠী চায়না যে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাক। তারা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে রেখে তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে চায়। এর মাধ্যমে সেই সশস্ত্র গোষ্ঠী মিয়ানমার সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্য চরিতার্থ করছে বলে মনে করেন সে কর্মকর্তা। সম্প্রতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেবার পর সে গোষ্ঠী অনেক রোহিঙ্গাকে ভয়ভীতি দেখিয়েছে যাতে তারা ফিরে যেতে রাজী না নয়। স্থানীয় প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন।

সংকটের দুই বছর পূর্তিতে রোহিঙ্গারা কুতুপালং শিবিরে বড় সমাবেশের আয়োজন করে। প্রশাসনের দুশ্চিন্তা কক্সবাজারে অবস্থানকালে আমি সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেছি। এদের মধ্যে স্থানীয় প্রশাসন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত কর্মকর্তা, পুলিশ এবং বিজিবি সূত্রগুলোর সাথে কথা বলেছি।

রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট যখন শুরু হয়, তখন অনেকেই আশংকা প্রকাশ করেন যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে ঘিরে জঙ্গি তৎপরতা তৈরি হতে পারে। এর একটি বড় যুক্তি ছিল, জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো হয়তো তাদের সদস্য সংগ্রহের জন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে টার্গেট করতে পারে।

তাছাড়া নির্যাতিত রোহিঙ্গারা হয়তো প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠবে মিয়ানমার বাহিনীর উপর। সেজন্য তারা বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করতে পারে - এমন আশংকাও ছিল অনেকের মনে। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে শুরু থেকেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তা ও নজরদারি বাড়িয়েছে বাংলাদেশে সরকার।

স্থানীয় প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন,"পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, আগামী কয়েক বছর পর রোহিঙ্গারাই ক্যাম্পগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে। সে কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গাদের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী ইয়াবা চোরাচালানের সাথে জড়িত। এখান থেকে টাকা আয় করে নিজেদের সংগঠন চালানোর জন্য খরচ করে তারা।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আশরাফুল আফসার বলেন, রোহিঙ্গাদের 'নিজস্ব দ্বন্দ্বের' কারণে খুনোখুনিগুলো হচ্ছে এবং তার প্রভাব কক্সবাজারের আইশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উপরও পরছে।


এনজিও কর্মীদের উদ্বেগ কক্সবাজারে কর্মরত আন্তর্জাতিক সংস্থার একাধিক কর্মকর্তার সাথে  কথা হয়েছে। তাদের আশংকা হচ্ছে, শরণার্থী ক্যাম্পের পরিস্থিতি যেভাবে দিনকে দিন জটিল হয়ে উঠছে তাদের ক্যাম্পের ভেতরে নিরাপদে কাজ করা মুশকিল হয়ে উঠতে পারে।

এখনও পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের মাঝে এনজিও কর্মীদের গ্রহণযোগ্যতা আছে। সেটি না থাকলে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে বলে তাদের আশংকা। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের জন্য যদি আন্তর্জাতিক সাহায্য কমে যায় তাহলে সেটির নেতিবাচক প্রভাব পড়বে রোহিঙ্গাদের উপর। এখনো পর্যন্ত তারা এনজিও কর্মীদের সুদৃষ্টিতে দেখে।

যদি সাহায্যের মাত্রা কমে আসে তাহলে অচিরেই এনজিও কর্মীরা রোহিঙ্গাদের চক্ষুশূলে পরিণত হতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। অন্যদিকে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে বেসরকারি সংস্থাগুলো এরই মধ্যে 'অপরাধী' হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করেন,বেসরকারি সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের বেশি ত্রাণ সাহায্য দিচ্ছে বলে তারা মিয়ানমারে ফিরে যাবার আগ্রহ পাচ্ছেনা। এমন অবস্থায় বেসরকারি সংস্থাগুলো রয়েছে উভয় সংকটে।

দিনে নিরাপত্তা বাহিনীর টহল থাকলেও রাতে অরক্ষিত থাকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প। কী করবে প্রশাসন? নিরাপত্তা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে,রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলার দিকে তাদের তীক্ষ্ণ নজর রয়েছে তাদের। নিরাপত্তা ইস্যুতে গত ছয়মাস যাবত রোহিঙ্গাদের প্রতি কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছে।

কোন রকম অপরাধের সাথে জড়িত থাকার নূন্যতম প্রমাণ পাওয়া গেলেও তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যদি সশস্ত্র গোষ্ঠীর উপস্থিতি তাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে না কেন?

এমন প্রশ্নে এক কর্মকর্তা বলেন, এর কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথম কারণ হচ্ছে,শরণার্থী শিবিরের নিরাপত্তা বাহিনী কোন অভিযান পরিচালনা করলে সেটির আন্তর্জাতিকভাবে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে।

তাছাড়া যে কোন ধরণের অভিযান পরিচালনা হলে সাধারণ রোহিঙ্গারাও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে পারে। এছাড়া বিষয়টিকে মিয়ানমার সরকার এমনভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করতে পারে যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসীরা আছে। ফলে বিষয়টি তাদের পক্ষে যেতে পারে। তবে আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, শরণার্থী ক্যাম্পে অভিযান পরিচালনা করার মতো পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি।

সেজন্য নিরাপত্তা বাহিনীগুলো এখন ভিন্ন কৌশলে হাঁটছে। একজন কর্মকর্তা জানালেন, তারা বেছে-বেছে পদক্ষেপ নেবেন। অর্থাৎ যাদের বিরুদ্ধে কোন অপরাধ সংগঠনের নূন্যতম প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। নিরাপত্তাবাহিনীর সাথে তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হবার ঘটনাগুলো সে বিষয়টি প্রমাণ করে বলে মন্তব্য করেন এক কর্মকর্তা।

স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা ও বলছেন, পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। সেজন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ, বিদ্যুত সরবরাহ এবং সিসি ক্যামেরা স্থাপনসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেবার সুপারিশ করেছে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ।

রোহিঙ্গাদের শুধু নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি নয়, রোহিঙ্গাদের হামলায় কয়েকজন বাংলাদেশীও নিহত হয়েছে। সর্বশেষ একজন যুবলীগ নেতার হত্যাকাণ্ড স্থানীয় বাংলাদেশীদের মধ্যে উদ্বেগ এবং ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে প্রবেশের পর থকে রোহিঙ্গাদের অনেকের বিরুদ্ধে নানা অপরাধের অভিযোগে মামলাও হয়েছে।

এসব অভিযোগের মধ্যে রয়েছে হত্যা, মাদক, নারী পাচারসহ নানা ধরণের অপরাধ। কুতুপালং-এর লম্বাশিয়ার বাসিন্দা তানজিনা আক্তারের আশংকা করেন, রোহিঙ্গাদের কারণে ভবিষ্যতে হয়তো তাদের এ এলাকা ছাড়তে হবে। "ওরা আমাদেরকেই এ এলাকা ছাড়া করবে। কয়দিন পর আমাদেরকে মারবে," ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছিলেন তানজিনা আক্তার।

সবচেয়ে উদ্বেগের জায়গা হলো উখিয়া এবং টেকনাফে এখন রোহিঙ্গারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাংলাদেশীরা সেখানে এখন সংখ্যালঘু। সে কারণেই শরণার্থী ক্যাম্পের পরিস্থিতি কতদিন নিরাপত্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকবে সে উদ্বেগ রয়েই যাচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের মনে করেন।

সূত্র, বিবিসি নিউজ 

COMMENTS





নাম

অর্থ ও বাণিজ্য,237,আন্তর্জাতিক,732,কাপাসিয়া,343,কালিয়াকৈর,418,কালীগঞ্জ,253,খেলা,644,গাজীপুর,3947,চাকরির খবর,35,জয়দেবপুর,1581,জাতীয়,2970,টঙ্গী,912,তথ্যপ্রযুক্তি,512,ধর্ম,196,পরিবেশ,137,প্রতিবেদন,310,বিজ্ঞান,55,বিনোদন,698,ভিডিও,58,ভিন্ন খবর,142,ভ্রমন,115,মুক্তমত,27,রাজধানী,830,রাজনীতি,1057,লাইফস্টাইল,283,শিক্ষাঙ্গন,399,শীর্ষ খবর,10783,শ্রীপুর,482,সাক্ষাৎকার,12,সারাদেশ,649,স্বাস্থ্য,212,
ltr
item
GazipurOnline.com: রাতের আঁধারে রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণ করে কারা?
রাতের আঁধারে রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণ করে কারা?
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEg59UpV11hZZndy-O5Dm4gl1In7_yG8bWCeKsYbzfDAQDelL_b5G27KFdeuOJ2Y3Een12E8nrMvQcGqUqSdf1IKmjlj5ysILP4ROO0_Q2pn2IgvhVeb-nG3EFUCP7bi21EP7FS4zn-0Tc8/s1600/rohingya.jpg
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEg59UpV11hZZndy-O5Dm4gl1In7_yG8bWCeKsYbzfDAQDelL_b5G27KFdeuOJ2Y3Een12E8nrMvQcGqUqSdf1IKmjlj5ysILP4ROO0_Q2pn2IgvhVeb-nG3EFUCP7bi21EP7FS4zn-0Tc8/s72-c/rohingya.jpg
GazipurOnline.com
https://www.gazipuronline.com/2019/08/rohingya.html
https://www.gazipuronline.com/
https://www.gazipuronline.com/
https://www.gazipuronline.com/2019/08/rohingya.html
true
13958681640745950
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Read More Reply Cancel reply Delete By প্রচ্ছদ PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share. STEP 2: Click the link you shared to unlock Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy