ডেস্ক : বাংলাদেশ মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ২০২০ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়। কিন্তু থেকে এক দশক আগে এই চিত্র ভিন্ন ছিলো, হারিয়ে যেতে বসেছিল দেশি মাছের অনেক জাত। সেই পরিস্থিতিতে ‘প্রায় বিলুপ্তি’র মুখ থেকে ফিরে এসেছে ওই মাছগুলো।
যদিও গত কয়েক দশকে ১০০টিরও বেশি দেশি প্রজাতির মাছ বলা চলে বাজার থেকে প্রায় নেই হয়ে গেছে। তবে প্রাকৃতিক ও বাণিজ্যিকভাবে চাষের কারণে দেশের এই এক দশকে মাছের উৎপাদন বেড়েছে। সরকারি হিসাব মতে, দেশে এখন প্রতি বছর প্রায় ৪৫ লাখ মেট্রিক টনের বেশি মাছ উৎপাদন হয়। তবে এর বড় অংশটি ইলিশ। বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
সম্প্রতি ‘দ্য স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকোয়াকালচার-২০২০’ নামক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাদু পানির মাছের উৎপাদন বাড়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। দেশে বছরে ৯ শতাংশ হারে মিঠা পানির মাছের উৎপাদন বাড়ছে। এক্ষেত্রে প্রথম স্থানে রয়েছে ইন্দোনেশিয়ায়। দেশটিতে প্রতি বছর ১২ শতাংশ হারে মিঠা পানির মাছের উৎপাদন বাড়ছে।
গবেষকেরা জানান, ‘প্রায় বিলুপ্ত’ অবস্থা থেকে প্রাকৃতিক উপায়ে মাছের ফিরে আসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অগ্রগতি হয়েছে হাওড় এলাকা এবং মেঘনা নদীর অববাহিকায়। এর বাইরে গবেষণার মাধ্যমে কিছু প্রজাতির মাছ রক্ষা করা হয়েছে, যেগুলো এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, মোট ২৩টি প্রজাতির মাছ পুনরায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে। মাছগুলো হলো- পাবদা, গুলশা, টেংরা, শিং, মাগুর, গুজি, আইড়, চিতল, ফলি, মহাশোল, বৈরালী, রাজপুঁটি, মেনি, বালাচাটা, গুতুম, কুঁচিয়া, ভাগনা, খলিশা, বাটা, দেশি সরপুঁটি, কালিবাউশ, কই, গজার, গনিয়া।
এর বাইরে প্রাকৃতিক উপায়ে হাওড় অঞ্চল এবং মেঘনা নদীর অববাহিকায় মাছের উৎপাদন বেড়েছে। এসব এলাকায় রিটা, আইড়, বাগাইড়, নদীর পাঙ্গাস, শিলন, চিতল এবং দেশি সরপুঁটি মাছের সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছে বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিস।
মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, প্রজনন ও চাষাবাদ কৌশল উদ্ভাবনের মাধ্যমে এই ২৩টি প্রজাতির মাছকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এখন আরো ৭টি প্রজাতি নিয়ে গবেষণা চলছে। বাংলাদেশে এই মূহুর্তে ৮০০ হ্যাচারিতে মাছের পোনা চাষ করা হয়, ২০০৮ সালে দেশে হ্যাচারির সংখ্যা ছিল ২৫ টির মত।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে হাওড়-বাঁওড়, খাল, বিল, পুকুরসহ জলাশয়ের সংখ্যা বহুলাংশে সংকুচিত হয়ে গেছে। ফলে হারিয়ে যাচ্ছিল মিঠা পানির মাছের বহু প্রজাতি। ফলে গবেষণার মাধ্যমে সেগুলো আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা শুরু হয়, যার ফল এখন বাজারে গেলে টের পাওয়া যায়।’
মাহমুদ আরো জানান, পুনরায় ফিরিয়ে আনা মাছগুলো বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হচ্ছে। বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হওয়া মাছের মধ্যে পুকুর ও ডোবার মত বদ্ধ জলাশয়ে ৫৭ শতাংশ মাছ উৎপাদন হচ্ছে। দেশে ৮ লাখ হেক্টর বদ্ধ জলাশয়ে মাছ চাষ হয়।
এদিকে দেশের হাওড় এলাকায় জলাশয় ইজারা দেবার সরকারি পদ্ধতি বাতিল হবার কারণে গত এক দশকে মাছের উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানান বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিসের কর্মকর্তা বলরাম মহালদার।
তিনি আরো বলেন, ‘ইজারা পদ্ধতি চালু থাকাকালে জলাশয়ের ব্যবহারকারীদের দায়িত্বজ্ঞানহীন কিছু আচরণ যেমন মৌসুম শেষে জলাশয়টি পুরোপুরি সেচে ফেলা, রাসায়নিক ব্যবহার এসব কারণে মাছের প্রাকৃতিক আবাস ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হতো।’
বলরাম মহালদার আরো বলেন, ‘ইলিশ সংরক্ষণের জন্য বছরে কয়েকটি সময় যে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দেয়ার কারণে শুধু ইলিশই বাঁচে না। ওই একই আবাসস্থলে থাকা রিটা এবং আইড়ের মত মাছও সুরক্ষা পাচ্ছে। যেমন একটি নির্দিষ্ট সময় ইলিশ ডিম ছাড়ছে এবং বাচ্চা ফুটছে মানে প্রচুর জাটকা হচ্ছে, এই জাটকা আবার রিটা এবং আইড়ের প্রধান খাবার।’
বাংলাদেশে প্রায় ৩০০ প্রজাতির দেশীয় মাছ রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় বিলুপ্তির পথে ১০০ টিরও বেশি। তবে সেগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক কানিজ ফাতেমা বলেন, বর্তমানে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে দেশীয় প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে সাহায্য করছে।
তিনি আরো বলেন, ‘এই মূহুর্তে বাজারে যেসব মাছ পাওয়া যায় তার ৫৬ শতাংশই চাষের মাছ। চাষের টেংরা মাছ চাহিদা আছে বাজারে ব্যাপক হারে চাষাবাদ হবার কারণে এসব মাছের দামও এখন সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে, ফলে একদিকে দেশীয় উদ্যোক্তাদের যেমন কর্মসংস্থান হচ্ছে, তেমনি অর্থনীতির উন্নয়নও তো হচ্ছে।’
কানিজ ফাতেমা আরো বলেন, এখন এই দেশীয় প্রজাতির মাছের প্রত্যাবর্তন টিকিয়ে রাখা এবং আরো নতুন নতুন প্রজাতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। আর সেজন্য গবেষণা আরো বাড়াতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।
COMMENTS