আজ জাতীয় কবির ৪৪তম প্রয়াণ দিবস


বাংলা সাহিত্যের বিস্ফোরণ, বাঙালীদের প্রাণের কবি, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আজ সেই মহান কবির ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী।

বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের আগমন একজন বীরের মতোই। তাঁর কবিতা, গান, উপন্যাস ও গল্পে বাঙালি জেনেছে বীরত্বের ভাষা, দ্রোহের মন্ত্র। তিনি আছেন মানবতায়, প্রেম, সাম্যে। বাঙালির জীবনে তিনি জাগিয়েছেন নতুনের স্বপ্ন, তুলেছেন নতুন জীবনতরঙ্গ। বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান অনন্যসাধারণ।

১৮৯৯ সালের ২৫ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল। শৈশব থেকে বৈচিত্রময় জীবন নজরুলের। তার ডাক নাম ছিল দুখু মিয়া। ১৯০৮ সালে ইমাম ও খাদেম পিতা কাজী ফকির আহমদের মৃত্যু হলে নিজের ভরণ পোষনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। হাজী পালোয়ানের মাজারের সেবক এবং মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করেন।

অল্পবয়সেই ইসলাম ধর্মের শিক্ষায় নিজেকে দীক্ষিত করেন, যা পরবর্তীতে তাকে ইসলামিক সাহিত্য রচনায় অনন্য করে তুলে। ইসলামি গানের ভূবনে তিনি বুলবুল নামেও পরিচিত।

মক্তব, মাজার ও মসজিদ-জীবনের পর নজরুল রাঢ় বাংলার (পশ্চিম বাংলার বর্ধমান-বীরভূম অঞ্চল) কবিতা, গান আর নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক লোকনাট্য লেটোদলে যোগদান করেন। লোকনাট্যের দলে বালক নজরুল ছিলেন একাধারে পালাগান রচয়িতা ও অভিনেতা। নজরুলের কবি ও শিল্পী জীবনের শুরু এ লেটোদল থেকেই।

লেটোদল ছেড়ে নজরুল স্কুলে ফিরে আসেন। অভাব-অনটন আর ডানপিটে স্বভাবের দুখু মিয়া বার বার স্কুল বদল করেও নিতে পারেনি কোন ডিগ্রি। মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রিটেস্ট না দিয়ে ১৯১৭ সালের শেষদিকে নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।

১৯১৭ সালের শেষদিক থেকে ১৯২০ সালের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় আড়াই বছর নজরুলের সামরিক জীবনের পরিধি। এ সময়ের মধ্যে তিনি ৪৯ বেঙ্গলি রেজিমেন্টের একজন সাধারণ সৈনিক থেকে ব্যাটেলিয়ন কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন। উক্ত রেজিমেন্টের পাঞ্জাবি মৌলবির কাছে তিনি ফার্সি ভাষা শিখেন। এছাড়া সহ-সৈনিকদের সঙ্গে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সঙ্গীতের চর্চা অব্যাহত রাখেন, আর গদ্য-পদ্যের চর্চাও চলতে থাকে একই সঙ্গে।

রাঁচি সেনানিবাসে বসে তার রচিত ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী’ কোলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তাছাড়া ঐ সময়ে আরো প্রকাশিত হয় ‘মুক্তি’ ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের নিগার’, ‘ঘুমের ঘোরে’; 'কবিতা আশায়’, ‘কবিতা সমাধি’ প্রভৃতি। প্রকৃতপক্ষে নজরুলের আনুষ্ঠানিক সাহিত্যচর্চার শুরু করাচির সেনানিবাসে থাকাবস্থায়ই।

প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে ১৯২০ সালে নজরুল দেশে ফিরে কোলকাতায় সাহিত্যিক-সাংবাদিক জীবন শুরু করেন। মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর সদ্যরচিত 'বাঁধন-হারা' উপন্যাস এবং ‘বোধন’, ‘শাত-ইল-আরব’, ‘বাদল প্রাতের শরাব’, ‘আগমনী’, ‘খেয়া-পারের তরণী’, ‘কোরবানী’, ‘মোহরর্ম’, ‘ফাতেহা-ই-দোয়াজ্দহম্’ প্রভৃতি কবিতা প্রকাশিত হলে বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। বাংলা সাহিত্যের এ নবীন প্রতিভার প্রতি সাহিত্যানুরাগীদের দৃষ্টি পড়ে।

নজরুল ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন; তখন থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত দু'দশক বাংলার দুই প্রধান কবির মধ্যে যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা অক্ষুণ্ণ ছিল।

১৯২১ সাল সময়টা নজরুলের জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। এসময় তিনি মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে পরিচিত হন পুস্তক প্রকাশক আলী আকবর খানের সঙ্গে এবং তাঁর সঙ্গেই নজরুল প্রথম কুমিল্লায় বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে আসেন। এখানে তিনি প্রমীলার সঙ্গে পরিচিত হন।

১৯২২ সালে কবিতা আনন্দময়ীর আগমনে প্রকাশিত হয়। এই রাজনৈতিক কবিতা প্রকাশিত হওয়ায় পত্রিকার উক্ত সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। একই বছরের তার যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং ঐ সময় তাকে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর তাকে কুমিল্লা থেকে কোলকাতায় নিয়ে আসা হয়।

১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ৭ জানুয়ারি নজরুল বিচারাধীন বন্দি হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে এক জবানবন্দি প্রদান করেন। চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে এই জবানবন্দি দিয়েছিলেন। তার এই জবানবন্দি বাংলা সাহিত্যে 'রাজবন্দীর জবানবন্দী' নামে বিশেষ সাহিত্যিক মর্যাদা লাভ করেছে।

১৯২৪ সালের কোলকাতায় নজরুল ও প্রমীলার বিবাহ সম্পন্ন হয়। প্রমীলা ছিলেন ব্রাহ্মসমাজভুক্ত। তার মা গিরিবালা দেবী ছাড়া পরিবারের অন্যরা এ বিবাহ সমর্থন করেননি।

১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট নজরুলের গান ও কবিতা সংকলন 'বিষের বাঁশী' এবং একই মাসে 'ভাঙ্গার গান' প্রকাশিত হয়। দুটি গ্রন্থই ওই বছর অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়।

১৯২৬ সালে নজরুল কৃষ্ণনগরে বসবাস শুরু করেন এবং বাংলা গানে এক নতুন ধারার সংযোজন করেন। তিনি স্বদেশি গানকে স্বাধীনতা ও দেশাত্মবোধের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সর্বহারা শ্রেণির গণসঙ্গীতে রূপান্তরিত করেন।

নজরুল ছিলেন বাংলা গজল গানের স্রষ্টা। তিনি গজল সংযোজনের মাধ্যমে বাংলা গানের প্রচলিত ধারায় বৈচিত্র্য আনেন। তাঁর অধিকাংশ গজলের বাণীই উৎকৃষ্ট কবিতা এবং তার সুর রাগভিত্তিক।

১৯২৯ সালের ১০ ডিসেম্বর কলকাতার এলবার্ট হলে বাঙালিদের পক্ষ থেকে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে এক বর্ণাঢ্য সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তাতে সভাপতিত্ব করেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, অভিনন্দন-পত্র পাঠ করেন ব্যারিস্টার এস ওয়াজেদ আলি, শুভেচ্ছা ভাষণ দেন বিশিষ্ট রাজনীতিক সুভাষচন্দ্র বসু (নেতাজী) এবং রায়বাহাদুর জলধর সেন।

সাংবাদিকতার পাশাপাশি নজরুল বেতারে কাজ করেছিলেন। এমন সময়ই ১৯৪২ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। হোমিওপ্যাথি এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাসহ ইউরোপে তাকে উন্নত চিকিৎসা দেওয়া হয়। কিন্তু কবি আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেননি। ১৯৫৩ সালে অসুস্থ নজরুল চিকিৎসা না নিয়ে রোম থেকে পশ্চিমবঙ্গে ফিরে আসে।

১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের বিশেষ উদ্যোগে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। কবির বাকি জীবন বাংলাদেশেই কাটে। ১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ্যেরও অবনতি হতে শুরু করে। জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে।

১৯৭৬ সালের ২৫ আগস্ট ঢাকার পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) দেহত্যাগ করেন তিনি।

বেঁচেছিলেন ৭৭ বছর; যা কেবল সংখ্যা। যতদিন রবে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি, বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য তত দিন রবেন মানবতার কবি, প্রেমের কবি দ্রোহের কবি বিদ্রোহী কবি কোটি কোটি বাঙালির হৃদয়ে।

COMMENTS





নাম

অর্থ ও বাণিজ্য,237,আন্তর্জাতিক,732,কাপাসিয়া,343,কালিয়াকৈর,418,কালীগঞ্জ,253,খেলা,644,গাজীপুর,3947,চাকরির খবর,35,জয়দেবপুর,1581,জাতীয়,2970,টঙ্গী,912,তথ্যপ্রযুক্তি,512,ধর্ম,196,পরিবেশ,137,প্রতিবেদন,310,বিজ্ঞান,55,বিনোদন,698,ভিডিও,58,ভিন্ন খবর,142,ভ্রমন,115,মুক্তমত,27,রাজধানী,830,রাজনীতি,1057,লাইফস্টাইল,283,শিক্ষাঙ্গন,399,শীর্ষ খবর,10783,শ্রীপুর,482,সাক্ষাৎকার,12,সারাদেশ,649,স্বাস্থ্য,212,
ltr
item
GazipurOnline.com: আজ জাতীয় কবির ৪৪তম প্রয়াণ দিবস
আজ জাতীয় কবির ৪৪তম প্রয়াণ দিবস
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiYnH9HzXCzUxI8A4zumJRuXiVpM-FBLXvEi7LSriwvjhC9M2sV0vCviuf-rAculpchVCLPaOhAC03j-b1PG0TSCJuRszLVBK8XJotG_o59A6yvKxhijI-_LcsP5mybqH3JM3-psUtCplE/s0/nazrul.jpg
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiYnH9HzXCzUxI8A4zumJRuXiVpM-FBLXvEi7LSriwvjhC9M2sV0vCviuf-rAculpchVCLPaOhAC03j-b1PG0TSCJuRszLVBK8XJotG_o59A6yvKxhijI-_LcsP5mybqH3JM3-psUtCplE/s72-c/nazrul.jpg
GazipurOnline.com
https://www.gazipuronline.com/2020/08/nazrul.html
https://www.gazipuronline.com/
https://www.gazipuronline.com/
https://www.gazipuronline.com/2020/08/nazrul.html
true
13958681640745950
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Read More Reply Cancel reply Delete By প্রচ্ছদ PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share. STEP 2: Click the link you shared to unlock Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy