১লা মে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। এই দিনটি সমগ্র বিশ্বের নিপীড়িত শোষিত, বঞ্চিত শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের দিন। এই দিনটি শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনের ফসল। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ১৩৪ বছর ধরে বিশ^জুড়ে পালিত হয়ে আসছে এই দিনটি।
শ্রমিক দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার এবং মালিক শ্রমিক সম্পর্ক, দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা। বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে বিশ্বের নিপীড়িত-শোষিত শ্রমিকেরা তাদের দাবি-অধিকার মালিক শ্রেনীর নিকট তুলে ধরে।
পুরাতন সভ্যতা থেকে শুরু করে যুগ থেকে যুগান্তরে আধুনিক সভ্যতার নির্মানে শ্রমিকদের ভূমিকা আনস্বীকার্য। শ্রমিকদের ঘামের প্রতিটি ফোটায় নির্মান হয়েছে সভ্যতার এক একটি দেয়াল। ১লা মে সারাবিশে^ আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হয় তা অর্জিত হয়েছিল শ্রমিকদের বুকের তাজা রক্ত বিসর্জনের মাধ্যমে। এই দিনটি ১৯৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শহীদ শ্রমিকদের আত্মত্যাগের স্মরণ করে পালিত হয়। সেদিন দৈনিক আটঘন্টা কাজের দাবিতে শ্রমিকেরা হে মার্কেটের সামনে জমায়েত হয়েছিল। তাদেরকে ঘিরে থাকা পুলিশের প্রতি এক অজ্ঞাতনামার বোমা নিক্ষেপের পর পুলিশ শ্রমিকদের উপর গুলিবর্ষন শুরু করে। ফলে প্রায় ১০-১২ জন শ্রমিক নিহত হয়। দাবি আদায়ে শ্রমিকদের সেই আত্মত্যাগকে স্মরণ করতেই ১লা মে বিশ^ শ্রমিক দিবস পালন করা হয়। সারা বিশ্বের মত বাংলাদেশেও এই দিনটি যথাযথ গুরুত্ব ও মর্যাদার সাথে পালন করা হয়। এই দিনে সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে দিবসটি পালন করে থাকে।
স্বাধীন বাংলার স্থপতি, স্বাধীনতার ঘোষক, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তার জীবদ্দশায় খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষ তথা শ্রমিকদের দাবি আদায়ের জন্য কাজ করে গেছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকদের কাছ থেকে শ্রমিকদের প্রাপ্য অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। শ্রমিকদের প্রাপ্য অধিকার আদায়ের ব্যাপারে তিনি ছিলেন সর্বদা সোচ্চার। ১৯৭১ সালে ২৬ শে মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে ছাত্র, শিক্ষক, পেশাজীবী সাধারণ জনতার সাথে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক ভাইয়েরা সেইদিন ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে। তাই স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনে শ্রমিকদের আত্মত্যাগ ভুলবার নয়। বর্তমান সময়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা, মাদার অফ হিউমিনিটি, প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ম জননেত্রী শেখ হাসিনা সর্বদা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাা”েছন শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার, তাদের ভাগ্যোন্নয়নে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর জননেত্রী শেখ হাসিনা শ্রমিকদের ভাগ্যোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
১। শ্রমজীবী মানুষের অভিজ্ঞতা ও কর্মদক্ষতাকে কাজে লাগানোর জন্য শ্রম আইন সংশোধন করে শ্রমিকদের অবসর গ্রহণের বয়স ৫৭ থেকে ৬০ বছরে উন্নিত করা।
২। শ্রম আইন ও শ্রমনীতি প্রনয়ন, শিশুশ্রম নিরসনে জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি প্রনোয়ন।
৩। বিভিন্ন ধরনের মেগা প্রকল্প গ্রহনের মাধ্যমে একদিকে যেমন দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে অন্যদিকে ঠিক তেমনি অসংখ্য লোকের কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে ।
বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে পোশাক শিল্প, রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার শতকরা ৮৫ ভাগই আসে পোশাক শিল্প থেকে এই পোশাক শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে ৬০ লক্ষ শ্রমিক জড়িত যার ৪০ লক্ষ শ্রমিকই নারী। ২০০৯ সালের জানুয়ারীতে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর জনতেত্রী শেখ হাসিনা সরকার রুগ্ন-মৃত প্রায় পোশাক শিল্পকে করেছেন উজ্জীবিত। পাশাপাশি দেশি-বিদেশী অপশক্তির হাত থেকে পোশাক শিল্পকে রক্ষায় অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছেন। আর পোশাক শিল্পের ৬০ লক্ষ শ্রমিকের ভবিষ্যত নির্মানে জননেত্রী শেখ হাসিনা করে যা”েছন নিরলস পরিশ্রম আর নিরন্তর চেষ্টা। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের জন্য নূন্যতম মুজুরী ৮০০০ টকা নির্ধারণ করেন যা পোশাক শিল্প মালিকেরা এবং শ্রমিকেরা সাধুবাদ জানিয়েছেন। সেই সাথে জননেত্রী শেখ হাসিনার এই মহা উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন অর্তনীতিবিদ, রাজনীতিবিদসহ সর্বস্তরের জনগন। তাছাড়া পোশাক শিল্পে ৪০ লক্ষ নারীর নিরাপদ কর্মসং¯’ানের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর অধিকার, সরকারের সুষ্ঠ ব্যব¯’াপনা ও তার হস্তক্ষেপের ফলে বিগত কয়েক বছর যাবৎ বাংলাদেশ পোশাক শিল্প রপ্তানিতে তার শক্ত অব¯’ান ধরে রেখেছে। পোশাক শিল্পে এরূপ অর্জনের কারণে বিদেশি বড় নামি-দামি পোশাক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে আরও পোশক কেনার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে যা আমাদের অর্থনীতির জন্য বড় একটি আশীর্বাদ। এর ফলে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেমন হবে তেমনি নতুন কর্মসং¯’ান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব দূর হবে।
![]() |
ইঞ্জি. মোঃ ইমরান হোসেন পলিন |
পোশাক শিল্পের সীমাহীন সাফল্যের মাধ্যমে কিছু দুঃখজনক ঘটনা আমাদের এই সাফল্যকে ¯ি’রমান করে দিয়েছিল, যেমনঃ রানা প্লাজা ধ্বস, তাজরীন ফ্যাশন অগ্নিকান্ড, স্মার্ট গার্মেন্টেসে অগ্নিকান্ড। এসব ঘটনা বিশে^র নামি-দামি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কাছে আবারও শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিলো। এতদসত্তে¡ও আমাদের প্রাণের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রানা প্লাজা ধসে আহত ৬ নিহত শ্রমিকদের জন্য নিজস্ব তহবিল থেকে ২৩ কোটি ৫৫ লক্ষ ৭২০ টাকা সাহায্য প্রদান করেন।
তাছাড়া ২০২০ সালে সারাবিশে^ যখন করোনা ভাইরাসের মহামারিতে আক্রান্ত, জর্জরিত ঠিক তখনও আমাদের আ¯’ার শেষ আশ্রয়¯’ল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পোশাক শিল্পের জন্য তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। গত বছর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে গত মার্চে একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিতাদেশ আসতে থাকে। এদিকে দেশেও ভাইরাসটির সংক্রামনরোধে সাধারণ ছুটি ঘোষনা করা হয় যাতে পোশাক শ্রমিকেরা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত না হয়। এতে করে পোশাক শিল্প রপ্তানিতে বাধার সৃষ্টির হয় যা পোশাক শ্রমিকদের জন্য মোটেও সুখবর ছিল না। কারণ গত জুনে শেষ হওয়া ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে মোট পোশাক রপ্তানি দাঁড়ায় ২ হাজার ৭৯৫ কোটি ডলারে, যা আগের ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের চেয়ে ৬১৮ কোটি ডলার কম। ওই অর্থবছরে ৩ হাজার ৪১৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছিলো। মার্চে পোশাকের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হওয়ায় মালিকেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়লে সরকার রপ্তানিমুখী কারখানার পোশাক শ্রমিকদের মজুরী দেওয়ার জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রনোদনা প্যাকেজ ঘোষনা করে। সেই তহবিল থেকে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কারখানার মালিক ০২ শতাংশ সার্ভিস চার্জে ঋণ নিয়ে তিনমাসের মজুরি দিয়েছেন। করোনা ভাইরাসের মহামারির থাবা যাতে পোশাক শিল্পের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে না পারে এবং পোশাক শ্রমিকেরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সজাগ দৃষ্টি রেখেছেন। যার ফলস্বরূপ করোনা মহামারির ধাক্কা সমালে পোশাক শিল্প তার চিরচেনা সাফল্যের রূপে এগিয়ে চলেছে। পোশাক শ্রমিকেরা যাতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত না হয় সেজন্য শিল্প কারখানাগুলোতে যথাযথ স্থাস্থ্যবিধি অনুসরণ করার জন্য আদেশ প্রদান করা হয়েছে।
তাছাড়া পোশাক শিল্পে আরো দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্য নতুন নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মান করা হচ্ছে। যারই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ও সর্বাধুনিক অর্থনৈতিক জোন। ইতিমধ্যে অনেক দেশি-বিদেশি পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠান তাদের ফ্যাক্টরী নির্মানের কাজ শুরু করেছে। এত করে এসব প্রতিষ্ঠানে সুযোগ হবে নতুন কর্মসংস্থানের আর দূর হবে বেকারত্ব। রপ্তানি আয় বাড়বে যা আমাদের অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক। সর্বোপরি দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি পোশাক শিল্পের উন্নয়নে জননেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা সর্বদা তার সজাগ দৃষ্টি রেখেছন।
লেখকঃ ইঞ্জি. মোঃ ইমরান হোসেন পলিন
COMMENTS