ডেস্কঃ গাজীপুরেই মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধের সূচনা হয়েছিলো। গাজীপুরের মাটি ঐতিহাসিকভাবে শিল্প সাহিত্যে, অসাম্প্রদায়িকতা ও স্বাধীনতার স্বপক্ষে অনুকূল ছিলো। তাই, বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের এই প্রবেশদ্বারটি অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক কারণে আলাদা আলাদা করে গুরুত্বের দাবীদার। গাজীপুর ভৌগলিক ও সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গাজীপুরে বাংলাদেশের একমাত্র সমরাস্ত্র কারখানা, টাকশাল, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র রয়েছে। গাজীপুরে একটি ক্যান্টনমেন্ট আছে, এবং এর পাশে সাভারেও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যান্টনমেন্ট। তাই, বলা যায় ভূ-রাজনৈতিক কারণে উত্তরের এই প্রবেশদ্বারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গার্মেন্টস, প্রযুক্তি, পর্যটনসহ নানা শিল্প বিকশিত হচ্ছে গাজীপুরে। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ হাইটেক পার্কও গাজীপুরে। গাজীপুরে ৫ হাজারের বেশী কারখানা আছে। তাই, কর্মসংস্থানের নিমিত্তে গাজীপুরের বাইরে থেকে আগমন ঘটেছে লাখ লাখ শ্রমজীবি মানুষের। বহিরাগত এসব শ্রমিকদের নানা দুর্বলতার সুযোগে গাজীপুর এখন আক্রান্ত হচ্ছে বারবার। গাজীপুরের গা থেকে বসে যাচ্ছে এর অসাম্প্রদায়িক জামাটি। গাজীপুরের রাজনীতিতে এখন বিভিন্ন ধরণের সঙ্কট ঘনীভূত হয়েছে এবং এর বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়েছে।
গাজীপুরের জনসংখ্যা ও কলকারখানার চিত্র:
২০২২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী গাজীপুরে ৫২ লাখের বেশি মানুষের বাস এবং ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের পরেই গাজীপুরে জনসংখ্যার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশী। গাজীপুরের মোট জনগোষ্ঠীর সিংহভাগই মুসলিম, মাত্র ৬ শতাংশ ভিন্ন ধর্মাবলম্বী। ভৌগলিক অবস্থান ও শিল্পঘনিষ্টতার কারণে গাজীপুরে প্রচুর বহিরাগতদের আগমন ও বসবাস। এসব বহিরাগতদের কেউ পেটের দায়ে অথবা কেউ অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে আসে এবং নানাভাবে ব্যবহৃত হয়। গাজীপুরের ৫ হাজারের বেশী কারখানার মধ্যে মাত্র ১,২০০ কারখানার অনুমোদন রয়েছে। করোনার পরে প্রতি মাসেই নতুন কারখানার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এসব কারখানায় প্রায় ২০ লাখ শ্রমিক কাজ করে যা অনেক ছোট দেশের মোট জনসংখ্যার সমান। অননুমোদিত কারখানার মতো এদের শ্রমিকরাও অননুমোদিত আর এদের অধিকাংশের ঠিকুজি স্থানীয় প্রশাসন বা আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর অজানা। তাই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের পরিবর্তে মাঝে মাঝে এরা হয়ে ওঠে বিষফোঁড়া। বয়সে কিশোর বা তরুণ এসব কারখানা শ্রমিকদের অধিকাংশই ন্যূনতম মজুরি পায় না। একদিকে আর্থিক অনটন অন্যদিকে ধর্মভীরতা ও অজ্ঞতা এদেরকে করে ফেলে ভালনারেবল। রাজনৈতিক ও অপরাধমূলক কর্মকান্ডে ব্যবহারের জন্য এদের চেয়ে সহজ টোপ আর নেই এবং এরা সংখ্যায়ও অনেক।
বহিরাগত শ্রমিকদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার:
এই সুযোগ নিয়ে বহিরাগত শ্রমিকদের ব্যবহার করা হয় অস্থিতিশীলতার উপাদান হিসেবে। অপরাধ ঘটিয়ে বিনা বাধায় তারা অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে অথবা পরিচয় লুকিয়ে ধারাবাহিক অপরাধ করে যেতে পারে। গাজীপুরের সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, স্থানীয় সরকার ও প্রশাসন গাজীপুরের সহিংসতা, জঙ্গিবাদ দমনে ব্যর্থ হয়েছে, এবং কিছু ক্ষেত্রে অপরাধীরা স্থানীয় রাজনৈতিক মদদও পেয়েছে। ধর্মের আফিম ও অর্থের বিনিময়ে বহিরাগতদের মাধ্যমে গাজীপুরের অপরাধমূলক কার্যক্রম অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে এবং রাজনৈতিকভাবে এদের অপব্যবহার ব্যপকহারে বেড়েছে। এতে গাজীপুরে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ও রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এটাকে বলা যেতে পারে রাজনীতির ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে যাচ্ছে গাজীপুর।
হঠাৎ করে মাদ্রাসার সংখ্যা বৃদ্ধি:
গোঁদের উপর বিষফোঁড়ার মতো পাজীপুরে প্রতিষ্ঠিত ও অনুমোদিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে এখানে গড়ে উঠেছে অসংখ্য অননুমোদিত মাদ্রাসা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, একটি ভবনের একটি বা দু'টি কক্ষ নিয়ে এদের কার্যক্রম এবং এদের অধিকাংশই রাষ্ট্রীয় শিক্ষা কারিকুলাম অনুসরণ করেই না। এদের ফান্ডিং কোথা থেকে আসছে সেটার কোন হদিস নেই, জবাবদিহিতা নেই। এবং মাদ্রাসার পরিচালনা পর্ষদের সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গি মানসিকতার মানুষ দিয়ে ঠাসা। সাম্প্রদায়িক শক্তির নিয়ন্ত্রণের পরিচালিত এসব মাদ্রাসাগুলি অসাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প ছড়ানোর হার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে এরা ধর্মভীরু মানুষের সহানভূতির সুযোগ নিতে পারে সহজেই। তারা সুকৌশলে নজরদারি এড়িয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বুনে দেয় সাম্প্রদায়িকতার বীজ এবং মনিটরিং ছাড়া মাদ্রাসাগুলি পরিণত হয় ছোট ছোট সাম্প্রদায়িক ঘাটিতে। এবং ধর্মের আবেগ কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ওয়াজের মাধ্যমে গাজীপুরের মানুষের মধ্যে ধর্মের নামী সাম্প্রদায়িকতার বীজ বুনে দেয়া হচ্ছে। উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বারের এর চেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে ধর্মীয় উম্মাদনাকে ব্যবহার করছে উঠতি কিশোর ও তরুণ সমাজ। তথ্যে দেখা গেছে সময়ের পরিক্রমায় গাজীপুরে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে।
গাজীপুরে সম্প্রতি অদ্ভুত এক তরুণ রাজনৈতিক শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছে। এই শ্রেণী মাদক ও ঝুটের ব্যবসায়ের মাধ্যমে অঢেল অবৈধ বিত্তের মালিক হয়েছে, কিন্তু শিক্ষা নেই এবং রাজনীতির র টা জানা নেই। গাজীপুরের শতকোটি টাকা ঝুটের ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে এই শ্রেণী রাজনীতিতে নাম লেখাচ্ছে। এদের অবৈধ ড্রাগমানির কাছে ঐতিহ্যবাহী এবং ত্যাগী রাজনীতিবিদের অসহায়। নব্যধনী এই তরুণদের একেকজন শুধু পোস্টারিং যত অর্থ ব্যয় করেন, গাজীপুরের একজন ত্যাগী রাজনীতিবিদ পুরো নির্বাচনেও এতো অর্থ ব্যয় করার কথা চিন্তাও করতে পারেন না। শুধু তাই না, স্থানীয় সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ পদ কিনে নেয়ারও গুরুতর অভিযোগ এদের বিরুদ্ধে প্রমাণিত। পদকেনাবেচার যেই টাকা পরিশোধ করা হয়েছে টেকনাফ থেকে। নজরদারির বাইরের বহিরাগত এবং গাজীপুরের রাজনীতির নব্যধনী বহিরাগত এই উভয়ই গাজীপুরের স্থিতি বিনষ্টের পেছনের মূল উপাদান এবং ভবিষ্যতে এটা বাড়তে দিলে আরো ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করবে।
গাজীপুরের নব্যধনী রাজনীতির বহিরাগত, বহিরাগত শ্রমিক এবং ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা মাদ্রাসাগুলি মিলে অদৃশ্য এক টাইমবোমার সেট করেছে গাজীপুরে। সঠিক ও পরীক্ষিত নেতৃত্বের মাধ্যমে এই বোমাকে নিষ্ক্রিয় না করতে পারলে, ঘটে যেতে পারে বড় অঘটন। আর এ অঞ্চলের যেকোন ঘটনা দেশকে রাজনৈতিকভাবে আক্রান্ত তো করেই। অর্থনৈতিকভাবেও বিপর্যস্ত করে ফেলে। এবং এর রেশ শুধু বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ থাকে না, প্রতিবেশী দেশগুলিতেও এর প্রভাব পড়ে। বর্তমানে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্ব যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক টারব্যুলেন্সের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, তাতে যেকোন ভুল নেতৃত্বের মাশুল দেশকে দিতে হবে। অনেক চড়া দামে।
আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং গাজীপুরের সন্তান বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন আহমেদ ও আহসান উল্লাহ মাস্টারের মৃত্যুর পর গাজীপুরের মানুষের আবেগ ও সক্ষমতা একাধিকবার ভুল পথে গিয়েছে। এটা হয়েছে অসাম্প্রদায়িক, শিল্পমনা ও শিক্ষিত নেতৃত্বের অভাবে। বর্তমান পরিস্থিতে গাজীপুরে ভুল নেতৃত্বের হাতে তুলে দেয়ার সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই। গাজীপুরের টাইমবোমাটি ফেটে গেলে তা বাংলাদেশতো বটেই আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের জন্যেও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে।
নেতৃত্বের প্রত্যাশা:
গাজীপুরে এমন একটি রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রয়োজন যার সুশিক্ষার পাশাপাশি সমৃদ্ধ রাজনৈতিক অতীত ও অভ্যাস আছে। এর পাশাপাশি আছে কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ ও সমন্বয়ের দক্ষতা। তিনি তার সহজাত নেতৃত্ব দিয়ে ও নিয়মিত মনিটরিং দিয়ে গাজীপুরের সঠিক সক্ষমতার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটাতে পারবেন এবং ধর্মের মোড়কে পুরে শান্তিপ্রিয় এই জনপদকে জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার কবল থেকে মুক্ত করতে পারবেন। সেই নেতার হাত ধরে গাজীপুর দেশের অর্থনৈতিক বিকাশে নেতৃত্ব দেয়ার পাশাপাশি মাতবে ভাওয়াল সংগীতে, গাজীর গীতে, পালাগানে লোকজ সংস্কৃতি ও উৎসবে।
রাজনৈতিক নেতৃত্বের আঞ্চলিক সমন্বয় দরকার:
গাজীপুর মহানগরের নেতৃত্ব উত্তর এবং দক্ষিণ এই দুই আঞ্চলিকতায় বিভক্ত। গাজীপুরের বিগত ৬০ বছরের রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিশ্লেষণ এবং ভোটের রাজনীতির বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, যত মন্ত্রী, এমপি, মেয়র নির্বাচিত হয়েছে হয় তারা টঙ্গী অঞ্চল অথবা (কাউলতিয়া, মির্জাপুর এবং বাসন) অঞ্চল থেকে হয়েছে। তাই সংগঠনের নেতৃত্ব নির্বাচনে এই বিষয়গুলো মাথায় রাখলে ভবিষ্যতে এই অঞ্চল ভোটের রাজনীতিতে সংগঠন উপকৃত হবে।
শিক্ষিত শ্রেণিকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পাশাপাশি কাজ করার উদ্দ্যোগ প্রয়োজন:
শিল্প অঞ্চলের পাশাপাশি গাজীপুরে বেশকিছু সুনামধন্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে- (১) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (২) ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর (৩)ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় অব টেকনলজি, (৪) জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, (৫) উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, (৬) তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজ। এছাড়াও সুনামধন্য প্রতিষ্ঠান (১) বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানা, (২) টাকশাল, (৩) বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফেক্টরি (৪) ডিজেল প্লান্ট, (৫) ধান গবেষণা, (৬) কৃষি গবেষণা, গাজীপুরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। চাকুরিসূত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা শিক্ষিত শ্রেণি পরবর্তীতে গাজীপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। রাজনৈতিক সংগঠন যদি শিক্ষিত, ভদ্র, দুর্নীতিমুক্ত সঠিক নেতৃত্ব নির্বাচন করতে পারে, তবে এই বিশাল শিক্ষিত শ্রেণিকে সহজে সমৃদ্ধ এবং উনাদের সমর্থন আদায় করতে পারে।
উৎসঃ বাংলা ইনসাইডার

Find us on Facebook
৭ দিনের জনপ্রিয়$type=list-tab$m=0$cate=0$sn=0$rm=0$$va=0
৩০ দিনের জনপ্রিয়$type=list-tab$m=0$cate=0$sn=0$rm=0$$va=0
সর্রাধিক জনপ্রিয়$type=list-tab$m=0$cate=0$sn=0$rm=0$$va=0
সর্বশেষ আপডেট$type=blogging$l=0$c=12$m=0$s=hide$rm=0$va=0$hide=home
দৃষ্টি আকর্ষণ
অপরাধের সূত্রপাত কিংবা ভোগান্তির কথা সরাসরি গাজীপুর অনলাইনে জানাতে ই-মেইল করুন। আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের সংবাদ প্রচার করতে চাইলে
ই-মেইল করুনঃ gazipuronline@gmail.com
গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের সংবাদ প্রচার করতে চাইলে
ই-মেইল করুনঃ gazipuronline@gmail.com
COMMENTS