গাজীপুরে পরিবহন নেতা সুলতান আহমেদ সরকারের বিরুদ্ধে পরিবহনে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে। সড়কে গাড়ী চলানোর জন্য কথিত ভর্তি, নবায়ন ফি, স্ট্যান্ড খরচ (জিবি’র) নামে ছোট বড় গাড়ী থেকে তার নিজস্ব লোকজন দিয়ে চাঁদা উত্তোলন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযুক্ত সুলতান আহমেদ সরকার গাজীপুর পরিবহন মালিক-শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি। তবে ওই নেতা অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবী করেছেন।
মঙ্গলবার (০৩ জানুয়ারী) বিকেলে গাজীপুর মহানগরীর একটি রেস্টুরেন্টে সংবাদ সম্মেলনে এমন অভিযোগ তুলেছেন চাঁদাবাজির শিকার সিএনজি চালিত অটোরিক্সা চালক এবং মালিকেরা। একইসাথে জমি দখলেরও অভিযোগ করেছে একটি ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্য নূরুন নাহার সাথী। তিনি গাজীপুর মহানগরের কাশিমপুর থানাধীন বাগবাড়ী এলাকার কফিল উদ্দিন আহমেদের কন্যা। তারা এসময় ওই পরিবহন নেতার পক্ষে মাঠ পর্যায়ে চাঁদা আদায়কারী ম্যানেজার, লাইনম্যান ও সিরিয়াল ম্যানদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া বিভিন্ন মামলার কপি, আদালতে দেয়া আসামী ও ভূক্তভোগীদের জবানবন্দীসহ বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করেন।
সুলতান আহমেদ সরকারের পিতা শামসুদ্দিন সরকার ৯১ সালে বিএনপি সরকারের সময় তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী লুৎফর রহমান খান আজাদের হাত ধরে গাজীপুরের পরিবহন জগতের নেতা হয়ে উঠেন। তার পিতার মৃত্যুর পর ২০১৩ সালের দিকে সুলতান আহমেদ সরকার গাজীপুর জেলা পরিবহন শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন। তারপর থেকে তিনি গাজীপুরের পরিবহন সেক্টরের একচ্ছত্র ও প্রভাবশালী নেতা হিসেবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। তার কমিটির সাধারণ সম্পাদক বর্তমান গাজীপুর মহানগর শ্রমিক দলের আহ্বায়ক ও সুলতান সরকারের আপন ছোট ভাই ফয়সাল আহমেদ সরকার। সুলতান সরকারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইমতিয়াজ আহমেদ শুভ প্রয়াত বিএনপি নেতা আরাফাত রহমান কোকোর সহযোগী ছিলেন। শুভর সাথে বর্তমানে জেলা বিএনপির এক শীর্ষ নেতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। শুভ ওই নেতাকে টাকা পয়সা দিয়ে সহযোগিতা করেন।
তিনি অভিযোগ করেন, সুলতান আহমেদ সরকার বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে বিভিন্ন সময়ে তোলা ছবি এবং তাদের নাম ভাঙ্গিয়ে গাজীপুর জেলার অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সড়ক মহাসড়কে চলাচলকারী যানবাহন থেকে চাঁদা আদায় করে থাকেন।
সুলতান সরকারের কমিটির আওতাধীন লাইনম্যান, সিরিয়াল মাস্টার, অফিস সহকারী বিভিন্ন পরিচয়ে শ্রমিকেরা বাস, ট্রাক, সিএনজিচালিত অটোরিক্সা স্ট্যান্ডসমূহ থেকে দৈনিক বা মাসিক ভিত্তিতে চাঁদা তুলে থাকেন।
এসব স্ট্যান্ডগুলোতে নতুন কোন গাড়ি নামানোর ক্ষেত্রে এককালীন এন্ট্রি ফি ৮ থেকে ১০ হাজার, এছাড়া প্রতিদিন সিরিয়াল বাবদ ৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। আর বাসের ক্ষেত্রে এন্ট্রি ফি ৪০-৫০ হাজার টাকা এবং দৈনিক চাঁদার পরিমাণ ৩৫০ থেকে ৭৫০ টাকা। মহানগরীর চন্দনা চৌরাস্তা, ভোগড়া, রাজেন্দ্রপুর, কোনাবাড়ী ফ্লাইওভার, মাস্টারবাড়ী, মীরের বাজার, বোর্ড বাজার এলাকায় এসব চাঁদা আদায় করার জন্য সুলতান সরকারের মনোনীত লোকজন কাজ করে থাকে। গাজীপুরের তাকওয়া পরিবহন থেকে প্রতিদিন ৭৫০ টাকা করে জিপি ফান্ডের নামে চাঁদা আদায় করে থাকেন।
রাজেন্দ্রপুর সিএনজি স্ট্যান্ডের সিএনজিচালক ও মালিক আক্কাস আলী বলেন, সুলতান সরকারের প্রতিনিধি হয়ে মোশারফ ও মামুন রাজেন্দ্রপুর এলাকায় লাইনম্যান হিসেবে চাঁদাবাজি করে। রোডে নতুন কোনো গাড়ী নামানো হলে সুলতান সরকারকে ৬ মাস মেয়াদে ১০ হাজার টাকার টোকেনে এন্ট্রি ফি দিয়ে নামাতে হয়। ৬ মাস পর আবার নতুন করে ১০ হাজার টাকা দিতে হয়। প্রতিদিন ৫০ টাকা করে জিপি ও ৫০ টাকা করে সিরিয়ালের জন্য টাকা দিতে হয়। না দিলে রোডে গাড়ী চালানো বন্ধ করে বসে থাকতে হয়।
এরকম একই ধরনের বক্তব্য দেন রাজেন্দ্রপুর সিএনজি স্ট্যান্ডের সিএনজি মালিক ও চালক সুমন মিয়া, পারভেজ জাহের, জামাল উদ্দিন, মনোয়ার হোসেনসহ অনেকে।
তারা জানান, চাঁদাবাজির ঘটনায় পুলিশ মোশারফ ও মামুনকে মাস দুয়েক আগে চাঁদাবাজির টাকাসহ হাতেনাতে গ্রেফতার করে। তারা সুলতান সরকারের প্রতিনিধি। সুলতান সরকারের চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করলে সুলতান সরকার বিভিন্ন লোক দিয়ে মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদেরকে হয়রানি করে। কিন্তু গত ৬ মাস আগেও সুলতান সরকারের নামে কোনো অভিযোগ দিতে গেলে পুলিশ তা আমলে না নিয়ে উল্টো অভিযোগকারীকে ধমক দিয়ে পাল্টা অভিযোগের ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দিত। অবশেষে গত দুই মাস যাবত পুলিশ অবশ্য আমাদের অভিযোগ আমলে নিয়ে বিচারকাজে সহায়তা করছে।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরো অভিযোগ করেন, এসব চাঁদাবাজির ঘটনায় সুলতান সরকারের সহযোগীদের নামে সিএনজি চালক শরীফ মিয়া বাদী হয়ে চলতি বছরের ২৬ অক্টোবর, সিএনজি অটোরিক্সার চালক নাসির উদ্দিন বাদী হয়ে ২০ জুলাই মহানগরীর বাসন থানায় এবং সিএনজি চালক আক্কাস আলী বাদী হয়ে মহানগরীর সদর থানায় গত ৮ নভেম্বর সুলতান সরকারের ৫ সহযোগীর নাম উল্লেখ করে অপর একটি মামলা দায়ের করেন। এসব মামলায় ধৃত আসামিদের কেউ কেউ বিজ্ঞ আদালতে সুলতান সরকারের নাম উল্লেখ করে ১৬৪ ধারায় গাজীপুর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক নিয়াজ মাখদুম ও ইকবাল হোসেনের কাছে জবানবন্দী প্রদান করেছেন।
মামলার এজাহার ও স্বীকারোক্তিতে দেখা যায়, ধৃত ও পলাতক আসামিগণ মহানগরীর তাকওয়া পরিবহনের বাস থেকে দৈনিক ৭৫০ টাকা করে, ভোগড়া বাইপাস এলাকায় বিভিন্ন ভ্যান-ট্রাক ও সিএনজি অটোরিক্সা হতে ১০০ টাকা করে, চান্দনা চৌরাস্তা, রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তা এলাকা দিয়ে যাতায়াত করা বিভিন্ন আন্ত:জেলা বাস সার্ভিস থেকে দৈনিক ৫০০ টাকা, গাজীপুর কাপাসিয়া-শিববাড়ী সড়কে চলাচলকারী রাজদূত ও পথের সাথী পরিবহন হতে ৫০০ টাকা, রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তা ময়মনসিংহ অভিমুখী বাস মিনি বাসসহ মহানগরের উপর দিয়ে চলাচলকারী বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কের পরিবহন থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করে থাকেন।
চলতি বছরের ২৬ অক্টোবর বাসন থানায় দায়ের করা একটি চাঁদাবাজির মামলার (নং-২৬) আসামী খোকন মিয়াকে গাজীপুর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়াজ মাখদুমের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে বলেন, সুলতান সরকার তাকে ভোগড়া বাইপাসে সিএনজি স্ট্যান্ডে নাইম ও জুয়েল কিভাবে ডিউটি করে তা দেখাশোনার জন্য নিয়োগ দেয়। সিএনজি স্ট্যান্ডে প্রতিদিন শতাধিক সিএনজি চলাচল করে। নাঈম ও জুয়েল সেখান থেকে ৫০/১০০ টাকা করে নেয়। এই টাকা কালেকশন করে প্রতি সপ্তাহে সুলতান সরকারের কাছে পৌঁছাতে হয়। সুলতান সরকার এর জন্য তাকে ১০ হাজার টাকা বেতন দেয়। নতুন সিএনজি নামানো হলে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। তারা সুলতান সরকারের কর্মী হিসেবে বেতন পায়। মামলার অপর এক অভিযুক্ত নাঈম ইসলাম একই ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তার জবানবন্দীতে জানায়, গত ৬ বছর যাবত সে ভোগড়া বাইপাস এলাকায় সিএনজি লাইনম্যান হিসেবে কাজ করে আসছে। প্রতিদিন প্রতি গাড়ী থেকে ১’শ টাকা করে চাঁদা তুলে আসছিল। এ থেকে প্রতিদিন ৬/৭ হাজার টাকা উত্তোলন করা হতো। সে চাঁদা উত্তোলনের জন্য প্রতিদিন ৭’শ টাকা করে পেত। বাকি টাকা প্রতি সপ্তাহে একদিন সুলতান সরকারকে দিয়ে আসতো। গত এক বছর যাবত সে সুলতান সরকারকে সরাসরি এ টাকা নিয়মিত দিয়ে আসছে। এর আগে সুলতান সরকারের ম্যানেজার খোকনের কাছে টাকা পৌঁছে দিত।
নূরুন নাহার সাথী অভিযোগ করেন, মহানগরীর কাশিমপুর এলাকায় তাদের এক একর ৮০ শতাংশ জমি রয়েছে। সুলতান সরকার ও তার সহযোগী ইমতিয়াজ করিম শুভ জমি দখলের লক্ষ্যে তাদের বিরুদ্ধে মহানগরীর বিভিন্ন থানায় দুই ডজনের বেশি মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। মামলা হওয়ার পর পুলিশ আসামি গ্রেফাতার করে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠায়। আবার আইনী প্রক্রিয়ায় জামিনে মুক্ত হন। কিন্তু গত প্রায় সাত বছর যাবত এসব মামলার কোন তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হচ্ছে না। ফলে এসব মিথ্যা মামলায় তিনি পরিবারের সদস্যসহ পরোয়ানা মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। স্বাভাবিক জীবেন ফিরতে না পেরে এবং কাজকর্ম করতে না পেরে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
এসব হয়রানির বিষয়ে ন্যায় বিচার চেয়ে তারা গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার বরাবর লিখিত আবেদন করেছেন। মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দিয়ে বিচারকাজের দ্রুত নিষ্পত্তির দাবী করেন তারা। তারা ন্যায় বিচারের জন্য সরকারের উচ্চ মহলের সুদৃষ্টি প্রার্থনা করছেন।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে গাজীপুর পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি সুলতান আহমেদ সরকার সাংবাদিকদের বলেন, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর কোনো সত্যতা নেই। প্রয়োজনে আপনারা তদন্ত করুন। যেসব অভিযোগগুলো করা হয়েছে তার কোনো সত্যতা নেই।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি’র) কমিশনার মোল্ল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, একটি পরিবারকে হয়রানির অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগ তদন্ত করে দোষী সাব্যস্ত হলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অন্যায়ভাবে কেউ যেন হয়রাানির শিকার না হয় সে দিকটি সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণে থাকবে। এছাড়া পরিবহনে চাঁদাবাজির বিষয়ে যে মামলা হয়েছে সেই মামলাগুলোর ভিকটিম ও সাক্ষীগণের জবানবন্দী ম্যাজিস্ট্রেট কর্র্তৃক গৃহীত হয়েছে।

Find us on Facebook
৭ দিনের জনপ্রিয়$type=list-tab$m=0$cate=0$sn=0$rm=0$$va=0
৩০ দিনের জনপ্রিয়$type=list-tab$m=0$cate=0$sn=0$rm=0$$va=0
সর্রাধিক জনপ্রিয়$type=list-tab$m=0$cate=0$sn=0$rm=0$$va=0
সর্বশেষ আপডেট$type=blogging$l=0$c=12$m=0$s=hide$rm=0$va=0$hide=home
দৃষ্টি আকর্ষণ
অপরাধের সূত্রপাত কিংবা ভোগান্তির কথা সরাসরি গাজীপুর অনলাইনে জানাতে ই-মেইল করুন। আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের সংবাদ প্রচার করতে চাইলে
ই-মেইল করুনঃ gazipuronline@gmail.com
গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের সংবাদ প্রচার করতে চাইলে
ই-মেইল করুনঃ gazipuronline@gmail.com
COMMENTS