দুই বছর পর আগামী ১৩ জানুয়ারি শুরু হতে যাচ্ছে মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েত বিশ্ব ইজতেমা।
কনকনে শীত ও ঘন কুয়াশা উপেক্ষা করে ইতিমধ্যেই ইজতেমা ময়দানের প্রয়োজনীয় কাজ প্রায় সম্পন্ন করছেন মুসল্লিরা।
এ উপলক্ষে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে সাধারণ মুসল্লিদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে তাবলিগ জামাতের দুই গ্রুপের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিয়ে। বিশ্ব ইজতেমায় সাম্প্রতিক মারামারিসহ খুনোখুনির ঘটনাই এ শঙ্কার কারণ।
তবে দুই পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে এবারের বিশ্ব ইজতেমা শুরু হতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
আগামী ১৩ জানুয়ারি শুরু হয়ে ১৫ জানুয়ারি রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটবে এবারের প্রথম পর্বের (জুবায়েরপন্থি) বিশ্ব ইজতেমার।
মাঝে চার দিন বিরতি দিয়ে ২০ জানুয়ারি দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজের অনুসারী (মাওলানা সাদপন্থি) মুসল্লিরা বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে অংশ নেবেন।
শুক্রবার দুপুরে ইজতেমা মাঠে গিয়ে দেখা গেছে, মুসল্লিরা ময়দানের বিভিন্ন স্থানে চটের তাঁবু টানাতে ব্যস্ত। মুসল্লিদের একজন আমান উদ্দিন জানান, তিনি পুরান ঢাকার চকবাজার থেকে এসেছেন। তারা ১৫ জন শুক্রবার ভোর থেকে টঙ্গীর স্টেশন রোডসংলগ্ন ময়দানের কাজ শুরু করেন।
ভোরে কনকনে শীত আর ঘন কুয়াশায় পুরো ময়দানে অন্তত পাঁচ শতাধিক মুসল্লিকে কাজ করতে দেখা যায়।
ইজতেমা ঘিরে এবার কোনো শঙ্কা আছে কি না জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই মুসল্লিদের একজন বলেন, করোনার কারণে গত দুই বছর বিশ্ব ইজতেমা হয়নি। এবার ইজতেমায় আসব। তাই অনেক আনন্দ লাগছে।
কারণ আল্লাহর সান্নিধ্য পেতে হলে তাবলিগের বিকল্প নেই। আমাদের নবীজিও দাওয়াতের কাজে সর্বক্ষণ সময় দিয়েছেন।
তিনি বলেন, পবিত্র হজের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েত এটি। বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা এখানে আসেন। আল্লাহর দরবারে বৃহত্তম মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়।
আল্লাহ আমাদের এবং আমাদের মা-বাবাসহ সবার গুনাহ মাফ করে দেবেন-এ প্রত্যাশা নিয়ে আমরা তাবলিগ জামাত এবং ইজতেমায় আসি।
তবে আমরা তাবলিগের দুই গ্রুপ চাই না। এবারও দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়েছে। প্রথম গ্রুপ মাওলানা জুবায়ের সাহেবের দ্বিতীয়টি সাদ সাহেবের।
এদিকে শুক্রবার বিকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সভাপতিত্বে বিশ্ব ইজতেমার প্রস্তুতির সর্বশেষ অবস্থা জানতে (ফলোআপ) টঙ্গীর ইজতেমা মাঠসংলগ্ন বাটা রোডে সভা হয়।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, নানা কারণে দুইভাগে বিশ্ব ইজতেমা সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায় দুই গ্রুপের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়ে গেছে।
ইজতেমা আয়োজক কমিটির দুই পক্ষের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। নতুন করে আর ভুল বোঝাবুঝির কিছু নেই। দুই গ্রুপই মিলেমিশে সুন্দরভাবে ইজতেমা শেষ করবে। ইজতেমার নিরাপত্তায় পুলিশ, র্যাব, আনসার প্রয়োজনে বিজিবিও প্রস্তুত থাকবে। সামরিক বাহিনীও সহযোগিতা করছে।
বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে আসা মুসল্লিদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। বিশেষ করে এবার বিদেশি মেহমানদের জন্য নিরাপত্তাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হবে।
প্রথমপর্বে আসা বিদেশি মুসল্লিরা আখেরি মোনাজাতের পর বিমানবন্দর হাজি ক্যাম্পে অবস্থান করবেন। সেখান থেকে তারা তাদের নিজ নিজ দেশে ফিরবেন।
এদিকে এবারও মাওলানা সাদ ও মাওলানা জুবায়ের গ্রুপের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দের বিষয়টি স্পষ্ট। শুক্রবার ফলোআপ সভায় উভয় গ্রুপের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের শঙ্কা প্রকাশ করে খোদ তাবলিগ জামাত বাংলাদেশ।
সংগঠনের আহলে শুরার পক্ষ থেকে বিভিন্ন শঙ্কা প্রকাশ করে সৈয়দ ওয়াসিফ ইসলামের স্বাক্ষরিত একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করা হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে। ইজতেমা সফল করতে সেখানে ১০টি শর্তও জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে ইজতেমা মাঠের প্রবেশ মুখে আটটি রাস্তার মধ্যে তিনটিই বন্ধ রয়েছে মামলা জটিলতার কারণে। ফলে লাখ লাখ মুসল্লি ভোগান্তিতে পরবেন বলে জানিয়েছেন জুবায়েরপন্থি প্রকৌশলী মাহফুজ।
তিনি বলেন, ভিন্ন একটি মামলার দোহাই দিয়ে তিনটি পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে বিষয়টি সমাধানের জন্য অনুরোধ করেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের যুগ্মসচিব মিজানুর রহমান, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান এবং গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোল্ল্যা নজরুল ইসলামসহ ঊধ্বর্তন কর্মকর্তারা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়ে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোল্ল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশের মুসল্লিদের আগমনে পুলিশ, র্যাবসহ ১০ হাজারের অধিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে। ইজতেমা মাঠ ও আশপাশের এলাকা নিরাপত্তা চাদরে মোড়ানো থাকবে।
তিনি বলেন, জঙ্গিদের কোনো হুমকি নেই। সিসি ক্যামেরা, ওয়াচ টাওয়ার ও রুফটপ থেকে পুরো ইজতেমা ময়দানের নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ করা হবে।
এ ছাড়া স্পেশালাইজড টিমসহ প্রতিটি ‘খিত্তা’য় সাদা পোশাকে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করবেন। অগ্নিনির্বাপণের জন্য প্রতি খিত্তায় এবার দুটি করে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র রাখা হবে।
তুরাগে নৌ টহলও থাকবে। স্পেশাল ফোর্স হিসেবে থাকবে এন্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ)। আকাশে থাকবে হেলিকপ্টার টহল।
এ ছাড়াও সেনাবাহিনীর সদস্যরা তুরাগ নদের তীরে তৈরি করেছেন তিনটি পন্টুন। এর মাধ্যমে সাময়িকভাবে মুসল্লিরা এপার থেকে ওপারে যাতায়াত করতে পারবেন।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ১২টি নলকূপে ১২ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রতিদিন বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হবে।
প্রতিবছরের মতো এবারও উর্দু ভাষায় বয়ান করা হবে এবং বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মুসল্লিদের সুবিধার্থে বয়ানের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ও আরবি ভাষায় তর্জমা করা হবে।
COMMENTS