রোগবালাই কাছে ঘেঁষতে পারবে না– এমন একটি লোহাসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবনের গবেষণা করছিলেন কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. সিরিমল প্রেমকুমার। কিন্তু শ্রীলঙ্কার এক প্রত্যন্ত গ্রামে বেড়াতে গিয়ে তিনি আবিস্কার করলেন, ওইরকম ধানের জাত সেখানে বহু আগে থেকেই আছে। এরপর নতুন জাত উদ্ভাবনের চেষ্টা তিনি বাদ দিলেন।
তার গবেষণার বিষয় ছিল, সাধারণ খাবারে কীভাবে আরও পুষ্টি উপাদান যোগ করা যায়। কিন্তু তিনি দেখলেন, বিভিন্ন উপাদানে সমৃদ্ধ আলাদা আলাদা জাতের ধান গ্রামের কৃষকরা শত শত বছর ধরে উৎপাদন করে আসছে।
তাই নতুন জাত উদ্ভাবনের পরিকল্পনা থেকে সরে এসে কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষক গত দশ বছর ধরে বাদামি, বেগুনি, লাল ও আঠালো জাতের চাল নিয়ে গবেষণা করেছেন। বাজারে যখন ফর্সা আর সরু চালের জয়জয়কার, তখন ওইসব চালের কথা মানুষ একপ্রকার ভুলেই গেছে। তবে গ্রামের কৃষকদের কেউ কেউ তাদের পুরনো জাতের ধান খুব অল্প পরিমাণে হলেও উৎপাদন করে যাচ্ছেন।
গার্ডিয়ান এক প্রতিবেদনে লিখেছে, বৈশ্বিক খাদ্য চাহিদা পূরণে উচ্চ ফলনশীল সাদা চালের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি আর ডায়াবেটিসের ঝুঁকির কারণে এ চালের মান নিয়ে উঠছে প্রশ্ন।
এসব বিষয় চিন্তা করে প্রেমকুমার এ পর্যন্ত তিন শতাধিক ধানের জাতের একটি তালিকা তৈরি করেছেন, যেগুলো অ্যান্টি-ডায়াবেটিক, অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদানে সমৃদ্ধ এবং যেসব জাত ব্যাপকভাবে চাষাবাদ করা সম্ভব।
গার্ডিয়ানকে প্রেমকুমার বলেন, “সনাতন এই জাতগুলো কৃষকরাই সংরক্ষণ করেছে বহু বছর ধরে। আমরা একে ঔষধি চাল বলি, কারণ কৃষকরা এসব চালকে ‘ওষুধের মত’ বলেই দাবি করেন। আমরা এখন কেবল সেই দাবির যৌক্তিকতা যাচাই করার চেষ্টা করছি।”
প্রেমকুমারের গবেষণার ক্ষেত্র শ্রীলঙ্কা হলেও তার আশঙ্কা, গত একশ বছরে ধান চাষে যেভাবে শিল্পায়ন ঘটেছে, তাতে পুরো এশিয়াতেই হাজার হাজার ধানের জাত হারিয়ে গেছে।
সাদা ভাতের অভ্যাস ছেড়ে ফিরতে হবে লাল চালে?
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, এশিয়াজুড়েই প্রধান খাদ্যশষ্য হল ধান, আর বিশ্বের মোট উৎপাদনের ৯০ শতাংশ ধান এখানেই হয়। এ এলাকার মানুষের বছরে গড়ে ৭৮ কেজি চালের প্রয়োজন হয়, যা অন্য যে কোনো অঞ্চলের চেয়ে দ্বিগুণ। লাওস, কম্বোডিয়া ও বাংলাদেশে শর্করা ও প্রোটিনের প্রধান উৎসই হল চাল, কারণ ভাত ছাড়া আর যা যা তারা খায়, তার পরিমাণ নিতান্তই সামান্য।
কিন্তু বাজারে সাধারণত যেসব চাল পাওয়া যায়, সেগেুলো সাদা ও সরু দেখাতে মিলে পলিশ করে এর বাইরের পুষ্টিসমৃদ্ধ লাল বা বাদামি আবরণ ছেঁটে ফেলা হয়। এশিয়া মহাদেশে ডায়াবেটিসের ক্রমবর্ধমান যে সমস্যা, তার পেছনে সাদা চালকে এখন কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফাউন্ডেশনের ধারণা, ২০৪৫ সালের মধ্যে ভারত, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১৫ কোটি ২০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগবে; যদিও ২০০০ সালে এই সংখ্যা ছিল সাড়ে তিন কোটি।
অন্যদিকে চীন, জাপান ও থাইল্যান্ডসহ পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ২০৪৫ সালের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াবে ২৬ কোটিতে, অথচ ২০ বছর আগে এ সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ৪০ লাখ।
কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি এবং দীর্ঘমেয়াদী রোগ প্রতিরোধ বিশেষজ্ঞ ডা. বাসন্তি মালিক বলেন, দিনে দুই বা তিন বেলা সাদা ভাত খেলে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি ১৬ শতাংশ বেড়ে যায় বলে তারা গবেষণায় দেখতে পেয়েছেন।
সাদা চালে ফাইবার ও অন্যান্য ‘মাইক্রো-নিউট্রিয়েন্ট’ এর অভাব থাকে, ফলে এ চালের ভাত দ্রুত হজম হয় এবং রক্তে গ্লুকোজ ও ইনসুলিনের মাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পায়, যা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।
বাসন্তি মালিক গার্ডিয়ানকে বলেন, “বিগত বছরগুলোতে যে পরিবর্তনটা হয়েছে, সেটা হল চাল ক্রমবর্ধমানভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়েছে, সেইসঙ্গে মানুষ জীবনযাপনে আগের চেয়ে অলস হয়ে উঠেছে। শ্রমবর্জিত জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিশোধিত কার্বোহাইড্রেট ডায়াবেটিসের ঝুঁকি নিশ্চিতভাবেই বাড়িয়ে তুলছে।”
সাদা ভাতের অভ্যাস ছেড়ে ফিরতে হবে লাল চালে?
কম ছাঁটা লাল বা বাদামি চালে বেশি পরিমাণ ফাইবার ও ম্যাগনেসিয়াম থাকে। চাল বা ভাতই যাদের প্রধান খাদ্য, তাদের ক্ষেত্রে এই লাল চাল ডায়বেটিসের ঝুঁকি কমিয়ে আনতে পারে।
ভারতের সামাজিক আন্দোলন ‘ওওও’ ফার্মের সহপ্রতিষ্ঠাতা শৈলেশ আওয়াত কৃষকদের পুরনো সনাতন জাতের ধান চাষে ফেরানোর চেষ্টা করছেন। ভারত, শ্রীলঙ্কা এবং ফিলিপিন্স ঘুরে ঘুরে তিনি বীজ সংগ্রহ করছেন, যেগুলো সংরক্ষণ করা যায় এবং অন্য কৃষকদের চাষের জন্য দেওয়া যায়।
তিনি বলেন, “ভারতে এখন পুষ্টিবিদরা সবাই ভাত খাওয়াকে নিরুৎসাহিত করছেন। মানুষকে তারা বলছেন, ভাত স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ, ভাতে স্টার্চ বেশি থাকে, ভাত খেলে মুটিয়ে যাওয়া এবং হার্টের সমস্যা তৈরি হয়। কিন্তু চিকিৎসকরা ভুলে যান যে, ভারত ও চীনের মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে ওই ভাত খেয়েই বেঁচে আছে এবং তাতে তাদের পুষ্টি সমস্যা হয়নি।
“মূল সমস্যা হল, সবাইকে এখন একই রকমের ধান চাষ করতে বলা হচ্ছে এবং এটাই কৃষকদের ধ্বংস করছে। তারা এখন পুষ্টির ঘাটতিতে পড়ছে। নতুন চালের ভাত তাদের বেশি খেতে হচ্ছে, কারণ পাকস্থলী তো পরিমাণ বোঝে না, পুষ্টি বোঝে।”
গার্ডিয়ান লিখেছে, খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টার ধারাবাহিকতায় ১৯৬০ এর দশকে ‘উন্নত’ জাতের ধানের আবির্ভাব ঘটে। প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনকে কাজে লাগিয়ে বিপুল পরিমাণ শস্য উৎপাদনে ‘সবুজ বিপ্লব’ সাধিত হয়। উচ্চ-ফলনশীল ধান দেশগুলোকে খাদ্যে ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ’ করে তোলে।
বিগত বছরগুলোতে প্রচুর পরিমাণে চাল উৎপাদন ও সংরক্ষণের কৌশল উদ্ভাবিত হওয়ায় এ খদ্যপণ্যটির দাম স্থিতিশীল রাখা সহজ হয়েছে। অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে পরিবহন ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ায় গম ও ভুট্টার বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে।
উচ্চ ফলনশীল ধানের জাতগুলো খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের সফল হাতিয়ার হিসেবে সমাদৃত হলেও এসব জাতের কারণে বিভিন্ন অঞ্চলের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের সনাতন জাতগুলো হারিয়ে গেছে। সেসব জাতের যে আলাদা কিছু গুণ ছিল, সেসব কথাও মানুষ ভুলতে বসেছে।
সাদা ভাতের অভ্যাস ছেড়ে ফিরতে হবে লাল চালে?
শৈলেশ আওয়াত বলেন, উচ্চ ফলনশীল জাতগুলোকে‘উন্নত জাত’ বলে চালিয়ে আসলে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। ওই কথার মানে দাঁড়ায়, মানুষ আগে যে চাল খেত, তা ছিল অনুন্নত।
“অথচ সনাতন জাতের ধানের নিজস্ব পুষ্টিগুণ ছাড়াও নির্দিষ্ট পরিবেশের জন্য সেগুলো ছিল মানানসই। আর গবেষণাগারে উদ্ভাবিত জাতগুলোর জন্য বেশি বেশি সার ও কীটনাশক দিতে হচ্ছে। আগে কৃষক একবারের ফসল থেকেই পরেরবারের বীজধান সংরক্ষণ করত, এখন তাকে প্রতিবার নতুন করে বীজ কিনতে হচ্ছে।”
শৈলেশ আওয়াতের ভাষায়, ১৯৬৫ সালের আগে কৃষকই ছিলেন বিজ্ঞানী। ফসলের ক্ষেতই ছিল তার গবেষণাগার। এখন তারা কেবলই শ্রমিক, তারা আমার পেট আর ব্যাংক ভরানোর জন্য কাজ করেন।”
ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজের প্রাক্তন পরিচালক জন কাভানার মতে, সাদা চালে মানুষ ঝুঁকতে শুরু করে ১৯ শতকের শেষ দিকে, যখন জাপানের উদ্ভাবিত চাল কলগুলো ধান থেকে তুষ ছাড়িয়ে চাল তৈরির শ্রমসাধ্য কাজটি সহজ করে দিয়েছিল।
মেশিন তুষ ছাড়ানোর পর চাল ছেঁটে বাদামি অংশ ফেলে দিয়ে সাদা বানিয়ে ফেলে। অথচ মানুষ আগে বাদামি চালই খেত।
ছাঁটাই করা সরু চাল দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়। চাল পচে যাওয়া বা পোকায় ধরার ঝুঁকিও কমে যায়। ফলে জাহাজে করে চাল পরিবহন করাও সহজ হয়ে যায়। এসব সুবিধা ২০ শতকের শুরুর দিকে রমরমা বাণিজ্যের পথ খুলে দেয়। অন্যদিকে আগে যারা বাদামি চালে অভ্যস্ত ছিলেন, তারাও দ্রুত রান্না ও সহজে হজম হওয়ার ‘সুবিধার’ কারণে সরু চালে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন।
সাদা ভাতের অভ্যাস ছেড়ে ফিরতে হবে লাল চালে?
ডায়াবেটিস এশিয়ায় গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার বহু আগে থেকেই সাদা চালের সমস্যার কথা মানুষ জানত। ১৯৪০ এর দশকে ভারতে ভিটামিনের ঘাটতিজনিত বেরিবেরি রোগ এতটাই সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠেছিল যে চিকিত্সকরা মিলে ছাঁটাই করা চাল নিষিদ্ধের আহ্বান জানিয়েছিলেন।
কাভানা বলেন, মিলে ছাঁটাই করলে চালের প্রধান পুষ্টিউপাদানগুলো দূর হয়ে যেত কিনা, সেসময়ে তা নিশ্চিতভাবে জানা ছিল না। এখন যেহেতু মানুষ সেটা জানে, সুতরাং এখন আবার পুরনো চালে ফিরে আসা দরকার।
“মিলে ছাঁটাই করা আঁশবিহীন চাল এখন ডায়াবেটিস বাড়িয়ে দিয়েছে। চিকিত্সকরা বুঝতে পেরেছেন, সাদা চাল ব্যাপকভাবে ডায়াবেটিসের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে এবং মানুষকে তারা ফের বাদামি চালে ফিরে যেতে বলছেন।”
কাভানা মনে করেন, সরু আর সাদা চাল ছেড়ে এখন আবার পুরনো দিনের বাদামি চালে অভ্যস্ত হওয়া দরকার এবং তা সম্ভব। সেজন্য চালের বাজার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে, কারণ এখনকার মিলগুলো তৈরিই হয়েছে সাদা চাল উৎপাদনের জন্য।
তবে পুরনো পদ্ধতিতে বাদামি চাল উৎপাদন তুলনামূলকভাবে সময় ও ব্যয় সশ্রয়ী। আর এখন প্যাকেজিংও অনেক উন্নত হয়েছে। ফলে সংরক্ষণের সুবিধার জন্য চাল সরু করা আর জরুরি নয়।
সাদা চালে অভ্যস্ত জনগোষ্ঠীকে পুরনো বাদামি চালে ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে। কিন্তু মানুষ এক শতাব্দী আগে রুচি পরিবর্তন করে সাদা চালে ঝুঁকেছিল, এখন আবার তাদের রুচি পরিবর্তন করা অসম্ভব নয়।
খাদ্য উৎপাদনের অর্থনীতিতে পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে শৈলেশ আওয়াত বলেন, “আমরা একর প্রতি উৎপাদনের হিসাবে নজর দিই, কিন্তু আপনি যদি প্রতি একরে পুষ্টিগুণ বিবেচনা করেন, তাহলে দেশকে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।”
COMMENTS