পাঁচ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনকে খুবই ‘গুরুত্বপূর্ণ’ মনে করছে আওয়ামী লীগ। সেজন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই বলে ধারণা দলটির শীর্ষ নেতাদের। তাই মে-জুন মাসে রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তকে খুব সতর্কতার সঙ্গে দেখছে ক্ষমতাসীন দলটি।
বর্তমানে যারা দলীয় মেয়র রয়েছেন, তারাই আবার পাবেন দলের মনোনয়ন-এমনটাই ধারণা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের। অনেকটা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে গঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির মতোই, যেখানে রয়ে গেছেন আগের কমিটির সব নেতাই। দলটির একাধিক শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ এখনো নিশ্চিত করা না গেলেও আওয়ামী লীগের ধারণা শেষ মুহূর্তে তারা আসবে। ফলে তাদের অংশগ্রহণে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীরা পরাজিত হলে বিএনপি কথা বলার সুযোগ পাবে। আবার এই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলেও দলটি (বিএনপি) এ ইস্যু তাদের চলমান আন্দোলনকে শক্তিশালী করার কাজে ব্যবহারের চেষ্টা করবে বলে আশঙ্কা ক্ষমতাসীনদের।
এর ফলে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আরও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে আওয়ামী লীগ। তাই দলীয় মেয়র প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকবে ক্ষমতাসীনরা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, নিয়মের বাধ্যবাধকতা থেকে পাঁচ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। মে-জুন মাসে এই নির্বাচন হলে এর ফলাফলের প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে পড়বে-এটাই স্বাভাবিক। তাই এ নির্বাচন আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে বগুড়ার মতো জেলায় জনগণ যখন ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীকে নির্বাচিত করে তখন ধরেই নিতে হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। সিটি করপোরেশনগুলোতেও প্রচুর উন্নয়ন হওয়ায় তিলোত্তমা নগরীতে পরিণত হয়েছে এসব সিটি। তাই আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীদের জয়ী না হওয়ার কোনো কারণ নেই।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন যুগান্তরকে বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নানাবিধ ইকুয়েশন এবং প্রার্থীর ব্যক্তিগত ইমেজ অনেক কাজ করে। তবুও সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল জাতীয় নির্বাচনে পড়বে বলে আমি মনে করি। এ অবস্থায় দলের প্রধান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা অবশ্যই যোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন দেবেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করে যুগান্তরকে বলেন, এই নির্বাচন আমাদের জন্য একটি অগ্নিপরীক্ষা হিসাবে সামনে আসবে। তার কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। পাঁচ সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা খারাপ করলে তা জনগণের কাছে তুলে ধরবে তারা। বলবে সরকার জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। এ কারণে তাদের প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছে। আবার নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলে সেটাও বিদেশিদের বলতে পারবে-তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো বিকল্প নেই। কারণ আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন হলে সিটি করপোরেশনের হাল হবে। তারা (বিএনপি) এ ব্যাপারে জনমত তৈরির সুযোগও পাবে।
দলটির একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক যুগান্তরকে বলেন, রমজানে দ্রব্যমূল্যের অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে। বিদ্যুতের সংকট তো রয়েছেই। যুদ্ধের কারণে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হলে এমনি এমনি আরও বহু সংকট সামনে এসে উপস্থিত হবে। এই অবস্থার মধ্যে পাঁচ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই দলের হাইকমান্ড মেয়র প্রার্থী মনোনয়নে সতর্ক থাকবেন বলে তিনি মনে করছেন। প্রয়োজনে এই নির্বাচনে ১৪ দলের শরিকদের সক্রিয় করা উচিত।
আওয়ামী লীগের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক নাম প্রকাশ না করে যুগান্তরকে বলেছেন, সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগে পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের এই সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগ অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। এখানে জয়ী হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
পাঁচ সিটির মধ্যে রাজশাহীতে মেয়র রয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, খুলনায় দলের প্রবীণ নেতা তালুকদার আবদুল খালেক, বরিশালে সেরনিয়াবত সাদিক আবদুল্লাহ এবং গাজীপুরে নির্বাচিত মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বহিষ্কৃত হলে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পান আসাদুর রহমান কিরণ। বিএনপির একমাত্র মেয়র রয়েছেন সিলেটে আরিফুল হক চৌধুরী।
রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে খায়রুজ্জামান লিটনের জোরালো প্রতিদ্বন্দ্বী এই মুহূর্তে নেই। সেখানে এক সময় মেয়র পদে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। তিনি বর্তমানে সংসদ সদস্য। ফলে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে নিরাপদ অবস্থানে রয়েছেন জাতীয় নেতা এএইচএম কামরুজ্জামানের ছেলে এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন।
দলের হাইকমান্ডে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক। তিনি আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভায়ও ছিলেন। আগামীতে বড় কোনো ঘটনা না ঘটলে দলের পরীক্ষিত এই নেতাই পাবেন মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন-এমনটাই ধারণা শীর্ষ নেতাদের।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবত সাদিক আবদুল্লাহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য। মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে এটাই বড় কারণ। তাই দলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীরাই মনে করেন, মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে সাদিক আবদুল্লাহ এগিয়ে রয়েছেন। মেয়র পদে বরিশালে তার দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বীও তেমন কেউ নেই। কাজেই সাদিক আবদুল্লাহ আবারও মনোনয়ন পাবেন-এমনটাই মনে করছেন দলের নেতাকর্মীরা।
দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে। বহিষ্কৃত হন মেয়র পদ থেকেও। কিন্তু সম্প্রতি তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করেছে আওয়ামী লীগ। এতে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। এই সিটিতে আবারও জাহাঙ্গীর আলমের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে যুগান্তরকে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের একাধিক নীতিনির্ধারক।
গত নির্বাচনে সিলেট হাতছাড়া করে আওয়ামী লীগ। এখানে বিএনপির আরিফুল হক চৌধুরী মেয়র নির্বাচিত হন। সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরান করোনায় ২০২০ সালের জুন মাসে মারা গেছেন। এখানে আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে তীব্র মনোনয়নযুদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। স্থানীয় ও লন্ডনের নেতাদের যে কেউ মনোনয়ন পেতে পারেন।
সূত্রঃ আবদুল্লাহ আল মামুন, যুগান্তর
COMMENTS